সুমন আহমেদ: দক্ষ নবীন-প্রবীণ নেতাদের সমন্বয়ে খোলামেলা মত বিনিময়ে যোগ্যদের নিয়ে কমিটি করা হবে বলে যে আশ্বাস যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা পেয়েছিলেন তাদের প্রিয় বর্তমান লন্ডন প্রবাসী নেতার কাছ থেকে। কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটেছে। এছাড়াও ক্ষমতাসীন দলকে মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী কমিটির আশা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে যে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিলেন নেতাকর্মীরা, তাদের সেইসব কষ্ট ও অপেক্ষা এখন উল্টো উপহাস করছে বলে মন্তব্য করছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির কমিটিতে স্থান না পাওয়া নেতা কর্মীরা।
সোমবার যুক্তরাজ্য বিএনপির নতুন কমিটির চূড়ান্ত তালিকা গোপণে প্রচার হয়েছে। এই তালিকা প্রচারের পরই নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। প্রাণপ্রিয় নেতা’র সঙ্গে বৈঠকের আমেজ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইস্যু করা ইন্টারপোল ওয়ারেন্টের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতির মুহূর্তেই চূড়ান্ত করা নতুন কমিটির এই তালিকা নেতাকর্মীদের সব উৎসাহ যেন ম্লান করে দিয়েছে।
চিকিৎসাধীন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের আনন্দ, উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে সংগঠনটির যুক্তরাজ্য শাখার নেতাকর্মীদের। ওই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জায়গায় এখন শুধুই অসন্তোষ আর হতাশা। নতুন কমিটি চূড়ান্ত করার খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমিটির তালিকাও চলে আসে নেতাকর্মীদের হাতে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে এই তালিকা কেমন করে প্রকাশ্য হলো, এ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। কেউ বলছেন নতুন এই কমিটির খবর ভিত্তিহীন, আর কেউ বলছেন তারেক রহমান নিজে এটি বাজারে ছেড়েছেন টেস্ট কেইস হিসেবে।
যুক্তরাজ্যর বিভিন্ন সূত্রে মতে জানা যায়, শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুসকে সভাপতি ও কয়সর এম. আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে চূড়ান্ত করা ১৭১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন এই কমিটি অনুমোদন করেছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি হয়েছেন আব্দুল হামিদ চৌধুরী। মোট নয় জন সহ-সভাপতির মধ্যে রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, তৈমুছ আলী, লুৎফুর রহমান, মঞ্জুরুস সামাদ মামুন, শাহ আক্তার হোসেন টুটুল, গোলাম রব্বানী, শরীফুজ্জামান চৌধুরী তপন, মুজিবুর রহমান মুজিব ও আক্তার হোসেন। এছাড়া সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাসিম আহমেদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার সায়েম, শহীদুল ইসলাম মামুন, আতিক চৌধুরী পাপলু, নুরুল ইসলাম, আমসুর রহমান মাহতাব, করিম উদ্দিন, তাজুল ইসলাম, আহমেদ আলী ও আব্দুল হাইয়ের নাম রয়েছে কমিটিতে। সাংগঠনিক ও অর্থ সম্পাদক হয়েছেন যথাক্রমে জসিম উদ্দিন সেলিম ও হাবিবুর রহমান ময়না। নতুন কমিটির দুই শীর্ষ নেতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, মিডিয়া ও কমিউনিটিতেই শুধু অপরিচিত নন, দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেও তাদের চিনেন না, এমন অভিযোগ কোন কোন নেতাকর্মীর। আওয়ামী লীগের মতো একটি সরকারী দলকে মোকাবেলায় যে দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন সেই নেতৃত্ব আসেনি নতুন কমিটিতে, এমন মূল্যায়ন যুক্তরাজ্য বিএনপি’র অধিকাংশ নেতাকর্মীর।
সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক মহিদুর রহমান, বাতিলকৃত কমিটির আহ্বায়ক এম এ মালেক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম কেউই নেই কমিটিতে। তরুণদের মধ্যে মেধাবী হিসেবে ইতোমধ্যে যারা কমিউনিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদেরও কেউ নেই শীর্ষ পদগুলোতে। নেতাকর্মীদের ভাষায়, এমন একটি অপ্রত্যাশিত কমিটি দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন, ক্ষুব্ধও হয়ে উঠেন কেউ কেউ। কিন্তু ভয়ে কেউই নিজের নাম প্রকাশ করে মিডিয়াকে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলেছে ব্যারিস্টার সালামকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান এবং আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে সিলেটের একটি আসনে মনোনয়ন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারেক রহমান তাঁকে যুক্তরাজ্য বিএনপি’র কমিটি থেকে বাদ দিয়েছেন। সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মহিদুর রহমানকেও আশ্বাস দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটি ভালো পদ দেয়ার। আর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ মালেককে কোন আশ্বাস দেয়া হয়েছে তা কেউই বলতে পারেন না। মালেকও কোনো কথা বলতে চান না এ বিষয়ে।
বর্তমান চূড়ান্ত কমিটি করার আগে তারেক রহমান কি এই তিন নেতার সাথে কোনো পরামর্শ করেছিলেন? এমন প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে নেতাকর্মীসহ কমিউনিটিতে। আর কোন চিন্তায় তারেক রহমান যুক্তরাজ্য বিএনপি’র শীর্ষ পদে স্বল্প পরিচিত ও অনেকটা অনভিজ্ঞ নেতাদের নিয়ে এলেন, এটিরও হিসাব মিলাতে পারছেন না দলের ব্রিটেন শাখার নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন আসলে ব্রিটেনে দলের তৃণমূল পর্যায় ও কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে তারেক নতুন এই কমিটির তালিকা ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছেন বাজারে। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখার পরই চূড়ান্ত কমিটি ঠিক করবেন তিনি। নতুন কমিটির তালিকা দেখে যারা হতাশ তারা আশা করেন এই বিশ্লেষণই যেন সঠিক হয়।
অন্য একটি বিস্বস্থ সূত্র মতে, এই কমিটিই চূড়ান্ত করেছেন তারেক রহমান। আগামীকাল ৩০ মে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন তিনি নিজে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন। এমন পরিকল্পনা থাকলেও কমিটির তালিকা কোনোভাবে চলে আসে সাংবাদিকদের কাছে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কমিটির তালিকা শেয়ার হতে থাকলে শুরু হয় তোলপাড়। এই তোলপাড় শুধু যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই নয়, মিডিয়াসহ পুরো কমিউনিটির মধ্যেই এ নিয়ে চলতে থাকে আলোচনা-সমালোচনা। চূড়ান্ত করা কমিটি থেকে সাবেক শীর্ষ নেতাদের সবাই ছিটকে পড়েছেন, অপরিচিত ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হয়েছে শীর্ষ পদে, এমন অভিযোগ উঠে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
নেতৃত্বপ্রত্যাশী ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা বলেন, এত শ্রম ও অর্থ ব্যয় করলাম দলেরে পেছনে, বিনিময়ে নিজেতো কিছুই পেলাম না, দলও পেলো না একটি যোগ্য কমিটি। যুক্তরাজ্য বিএনপি নিয়ে এখন আমি অনেকটা হতাশ। তিনি বলেন, সরকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। সরকারের এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছি আমরা, ঠিক তখনই এই ধরনের একটি অগ্রহণযোগ্য কমিটি বাজারে ছাড়া হলো, এর পেছনে কি রহস্য থাকতে পারে বুঝতে পারছি না। যুক্তরাজ্য বিএনপি’র এই বহুল আলোচিত-সমালোচিত নেতার নেতৃত্বাধীন কমিটি এর আগে বাতিল হলেও বিএনপি থেকে তিনি একেবারে ছিটকে পড়বেন এটি অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। কারো কারো ধারণা মালেককেও নিশ্চয়ই কোনো একটি আশ্বাস দেয়া হয়েছে। নতুন কমিটি নিয়ে মহিদ, মালেক, সালাম সাবেক এই তিন শীর্ষনেতার নীরবতা নেতাকর্মীদের ফেলে দিয়েছে ব্যাপক বিভ্রান্তিতে।
Leave a Reply