হাবিবুর রহমান তাফাদার: ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক হিসেবে ঘোষনা করার পর দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও আন্দোলনের পর সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চালু হয়েছিল সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।
সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের তথাকথিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলেও প্রকৃতপক্ষে এখান থেকে শুধুমাত্র স্থানীয় ফ্লাইটই পরিচালনা করা হয়। রিফুয়েলিং ব্যবস্তা না থাকায় গত ১৭ বছর ওসমানী থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু সম্ভব হয়নি। জ্বালানী সমস্যার কারণে এর আগে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোরও কোন ফ্লাইট ওসমানীতে অবতরণ করেনি। ২৪ মার্চ ২০১৫ ইং তারিখ থেকে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নবনির্মিত রি-ফুয়েলিং স্টেশন থেকে পরীক্ষামূলকভাবে রিফুয়েলিং শুরু হয়।
ফলে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আর কোনো সমস্যাও ছিলনা। সম্প্রতি বাংলাদেশের রিজেন্ট এয়ারলাইনস ও ফ্লাই-দুবাই নামক দুবাই’র একটি এয়ারলাইনস সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রীদের প্রকৃত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বাদ দিতে একটি উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই এয়ারলাইনস দুটি সিলেট থেকে বিশ্বের অনেকগুলো দেশে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১লা এপ্রিল ২০১৫ ইং তারিখে ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনস সিলেট থেকে সরাসরি একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে। কিন্তু এরপরদিন থেকেই আর আসেনি ফ্লাই দুবাই। তারা পালিয়ে প্রান রক্ষায় বাধ্য হয়। শুরু হয় কানাঘুষা। কিন্তু কি কারনে আর এলনা ফ্লাই দুবাই? নানাজনে নানা প্রশ্ন।
সুরমা টাইমস’র তদন্তে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। সিলেট বিদ্ধেষীদের ষড়যন্ত্রের ফলেই সিলেটবাসীর বহুল প্রতিক্ষিত সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। আর এই ষঢ়যন্ত্রের জাল বিস্তারে প্রকাশ্যে আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’র গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং।
জানা যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কতৃপক্ষের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কতৃপক্ষের নানামুখি ষড়যন্ত্র; ফ্লাই দুবাই’র সাথে প্রতিকুল শর্তাবলীর কারনে ফ্লাই দুবাই সিলেটে তাদের সকল কার্যক্রম বাতিল করতে বাধ্য হয়। সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় সিলেটবাসী।
দ্যা বাংলাদেশ মনিটর সূত্রে জানা যায়, ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (ক্যাব) থেকে ফ্লাই দুবাই ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে একটি লিখিত আদেশে জানানো হয়, সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ধারনক্ষমতা ও মালামাল খালাসে লোকবল সংকটের কারনে সিলেট থেকে রিজেন্টস ও ফ্লাই-দুবাই এয়ারলাইনসের অনুমোদন বাতিল করা হল।
একই সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে ২০১১ সালের ১৫ই মার্চ ক্যাব (Civil Aviation Authority of Bangladesh) ও জিসিএএ (General Civil Aviation Authority (GCAA) of UAE) স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিতে সিলেটকেও বাংলাদেশের আরেকটি আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে সমজতা স্মারক সাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে বলা হয় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মানকাজ শেষ হলে ওসমানী বিমানবন্দর থেকেও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।
এয়ার সার্ভিসের বিধানানুসারে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার দুবাই’র (GCAA) সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে রিজেন্ট এয়ারওয়েজকেও বাংলাদেশের মনোনীত আরেকটি এয়ারলাইনস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজ বাংলাদেশ থেকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-আবুদাবি-ঢাকা রুটে ৫ টি ফ্লাইট পরিচালনা করার অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ সরকার (ক্যাব) দুবাই সকরের কাছে অনুরোধ পাঠায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার এয়ার এরাবিয়া ও ফ্লাইদুবাই এয়ারলাইনসকে সিলেটে ফ্লাইট পরিচালনা করার অনুমতি প্রদান করে। জিসিএএ ২০১৫ সালের ৫ মার্চ দুবাই-সিলেট-দুবাই রুটে রিজেন্ট এয়ারলাইনসের সাথে ফ্লাই দুবাইয়ের কোড শেয়ার করতে অনাপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে (ক্যাব) চিটি দেয় ।
ওই চিটিতে আরও বলা হয় যাত্রী পরিবহনের কাজ করবে ফ্লাই-দুবাই এবং মার্কেটিং করবে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। ওই সময় দুবাই-সিলেট-দুবাই রুটে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও ফ্লাইদুবাইয়ের মধ্যে কোড শেয়ারিং চুক্তিও ক্যাব অনুমোদন করে। ২০১৫ সালের ৫ই মার্চ ফ্লাই দুবাই ঘোষনা দেয় ১লা এপ্রিল ২০১৫ থেকে প্রতি সপ্তাহে দুবাই-সিলেট-দুবাই রুটে ৫ টি সরাসরি ফ্লাইট (রবি ও বৃহষ্পতিবার বাদে) পরিচালনা করবে ।
৪ মে ২০১৫ থেকে প্রতিদিন ১ টি করে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করারও ঘোষনা দেয় ফ্লাই দুবাই। রিজেন্টস এয়ার ওয়েজের সাথে যৌথ অংশিদারিত্বে ফ্লাই দুবাই’র সিলেট রুট পরিচালনা করার চুক্তি ছিল। এরই ভিত্তিতে ১০ই মার্চ ২০১৫ ক্যাব ফ্লাই দুবাই’র সিলেটে সিডিউলের অনুমোদন দেয়। এরই ভিত্তিতে ফ্লাই দুবাই টিকেট বিক্রি শুরু করে।
প্রথম চার দিনের মধ্যেই ফ্লাই দুবাই’র পুরো মাসের সকল টিকেট বুকিং হয়ে যায় বলে জানা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে বাদ সাধে বিমান কতৃপক্ষ। শুরু করে ষড়যন্তের জাল বুনতে। তারা সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাইদুবাই-রিজেন্টস’র মালামাল খারিজে সহায়তা (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
২৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালককে ক্যাব একটি চিটির মাধ্যমে অনুরুধ করে জানায় যে, ইতোমধ্যে ক্যাব কতৃপক্ষ রিজেন্টস এয়ারওয়েজ ও ফ্লাইদুবাই’র কোড শেয়ারিং চুক্তিতে সিলেটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে।
যেহেতু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সিলেট থেকে B777-300ER এর মাধ্যমে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে এবং তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস এই সহায়তা দিয়ে আসছে, এক্ষেত্রে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস অন্য অপারেটর’র অনুরুপ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস পরিচালনা করতে পুরোপুরি সক্ষম। রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ফ্লাই দুবাই’র সাথে কোড শেয়ারের মাধ্যমে B737-800 এয়ারক্রাফট দ্বারা ১লা এপ্রিল থেকে সিলেটে দুবাই থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। তাই বিমানকে ঐ ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং’র দায়ীত্ব দেয়া হল।
বিমান কতৃপক্ষ ক্যাবের ঐ চিটির কোন গুরুত্ব দেয়নি। তারা ক্যাবের এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। এরপর রিজেন্ট এয়ারওয়েজও বিমান কতৃপক্ষকে অনুরুধ করে যে যেহেতু রিজেন্টস এয়ারওয়েজ একটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। তারা বিমানের সাথেও কোডশেয়ার করে তাই বিমান যেন তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিংর কাজে সহায়তা করে থাকে। কিন্তু বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস রিজেন্টস’র অনুরুধও প্রত্যাখ্যান করে।
যেহেতু ফ্লাইদুবাই’র সিলেট রুটে এপ্রিল মাসের সকল ফ্লাইটের সকল টিকেট মাসের প্রথম চার দিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে; তাই মহাসংকটে পড়ে ফ্লাইদুবাই। পরিশেষে অনেক কঠিন শর্ত সাপেক্ষে শুধুমাত্র ১লা এপ্রিলের ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করতে সম্মত হয় বিমান কতৃপক্ষ। ফ্লাই দুবাই সংগোপনে তাদের প্রথম ফ্লাইট সম্পন্ন করেই বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রীক জটিলতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেয় সিলেট থেকে সরাসারি ফ্লাইট বন্ধ করার। আর যে সেকল টিকেট ইতোমধ্যেই বিক্রয় হয়ে গেছে সেই সকল যাত্রীদেরকে ঢাকা পর্যন্ত বাসে পরিবহন করতে বাধ্য হয়।
যাবতীয় তথ্য প্রমানাদি ঘাটালে দেখা যায় যে, ফ্লাই দুবাই’র সিলেটে কেন্দ্রীক ফ্লাইট পরিচালনার চরম ব্যার্থতার জন্য আইনি কোন ত্রুটি ছিলনা। কিছু সিলেট বিদ্ধেষী কর্মকর্তার বিদ্ধেষúূর্ণ আচরনের কারনেই সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রুপ নিতে পারলনা। ভবিশ্যতেও ফ্লাইদুবাই’র সিলেট থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা সম্পূর্ন অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেল। ফ্লাই দুবাই’র এই চরম ব্যার্থতার কারনে সিলেটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনায় এয়ার এরাবিয়াও পিছু হটেছে।
বিশ্বের সকল দেশই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সকে তাদের বিমানবন্দর ব্যাবহার করার জন্য সমীহ করে। যত প্রকার সহায়তা প্রদান করা দরকার তা করে; তবুও যাতে তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়, আন্তজতিক এয়ারলাইনসগুলো যাতে তাদের বিমানবন্দর নির্বিঘ্নে ব্যাবহার করে। আর আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার সিলেট বিদ্ধেষী সরকারী কর্মকর্তার কারনে শুধুই সিলেট নয়, একইসাথে জাতীয় স্বার্থও ব্যাহত হচ্ছে।