দুনিয়া জুড়ে ডেস্ক: ঢাকার অদূরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের শীর্ষ ১২ ঘটনায় স্থান করে নিয়েছিল। ২০১২ সালের নভেম্বরে ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার ওই দুর্ঘটনার খবর ফলাও করে ছাপে পত্রিকাটি। পরবর্তীতে রানা প্লাজার ধসের পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। একাধিক সংবাদপত্রে নেতিবাচক খবর প্রকাশের এই ধারা এখনো চালু রয়েছে। প্রতিদিনই খবর আসছে এবং তা কঠোর সমালোচনা করে। এসব সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বেশকিছু পর্যালোচনামূলক, বিশ্লেষণমূলক ও মতামতধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
শুধু নিউইয়র্ক টাইমসই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু জনপ্রিয় দৈনিকে বাংলাদেশের পোশাকখাত নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নেতিবাচক প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন পোস্ট, হাফিংটন পোস্ট, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, আটলান্টা জার্নাল কনস্টিটিউশন, সিএনএন, রয়টার্স, বিবিসি, টেলিগ্রাফ, টাইম, ইকোনমিস্ট প্রভৃতি সংবাদ মাধ্যম প্রধান শিরোনাম করে বাংলাদেশের পোশাকখাত নিয়ে। বাংলাদেশের শিল্পখাতে তাজরীনের রেশ না কাটতেই বিপর্যয় হিসেবে আসে রানা প্লাজার ধস। গত ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার কাছে সাভারে ওই ভবনটি ধসে নিহত হয় এক হাজার ১২৯ জন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন পোশাকশ্রমিক। রানা প্লাজা ধসের খবরটিও বছর শেষে নিউইয়র্ক টাইমসের শীর্ষ সংবাদ হিসেবে আসতে পারে! ঘটনার দিন থেকে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর পত্রিকাটি শীর্ষ সংবাদ হিসেবে স্থান পাচ্ছে।
ঘটনার পরে দিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল ‘মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো চাপে’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনের থাকা পোশাক কারখানাগুলোতে ব্রিটেনের প্রাইমার্ক, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল-মার্ট, কানাডার লোব্ল, ইতালির বেনেটনসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতা কোম্পানির জন্য পোশাক তৈরি হতো। প্রাইমার্ক ও লোব্ল রানা প্লাজার কারখানাগুলোর সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করলেও অস্বীকার করেছে ওয়াল-মার্ট ও বেনেটন। টিয়্যারস অ্যান্ড রেইজ অ্যাজ হোপস ফেডস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২৮ এপ্রিল সংবাদটিতে তুলে ধরা হয় স্বজন হারাদের আহাজারি আর বেদনার চিত্র। সংবাদের শুরুটা ছিল এভাবে-ধসে যাওয়া ভবনের এক পাশে দাঁড়িয়ে এক মা তার দুই সন্তানের (মেয়ে আসমা কাজ করত ভবনের চতুর্থ ফ্লোরের একটি কারখানায় ও ছেলে পঞ্চম ফ্লোরের কারখানায়) ছবিতে চুমু খাচ্ছে। ভবন ধসের পাঁচদিন হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা মৃত বা জীবিতভাবে অনেককেই উদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু ছেলে বা মেয়ে কেউ নেই তাদের মধ্যে। কখনও উদ্ধারকাজে নিয়োজিতদের, কখনও সৃষ্টিকর্তা আবার কখনও সন্তানদের নাম ধরে চিৎকার আর আহাজারি করছেন তিনি। বলছেন, “আজ আমি এখানে আর তোমরা ফিরে আসছ না।
বাংলাদেশ থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া, নিজেদের জন্য সরবরাহের জন্য দেওয়া অর্ডার বাতিল করা ও বাংলাদেশের কারখানাগুলোর কাজের পরিবেশের মান উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি নিয়ে ‘বাংলাদেশে নিজেদের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করছে কিছু খুচরা বিক্রেতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ১ মে প্রকাশ করে। বাংলাদেশে আরেকটি প্রতিরোধযোগ্য বিয়োগাত্মক ঘটনা’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় ছাপে পত্রিকাটি। ২৫ এপ্রিল পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ওই সম্পাদকীয় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে বুধবার আটতলা ভবন ধসে দুশ জনের বেশি নিহত হওয়ার ঘটনাটি আমেরিকান ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জন্য পোশাক তৈরিকারী লাখো লাখো বাংলাদেশির নিম্নমানের পরিবেশকে সামনে নিয়ে আসল। এই লাইনটির পরেই ছিল গত নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ নিহত হওয়ার বিষয়টি।
নিউইয়র্ক টাইমেসের সম্পাদকীয় পর্ষদ এসব বিপর্যয়ের ব্যাপকতা আর পুনরাবৃত্তির জন্য ওয়ালমার্ট, এইচএ্যান্ডএম ও গ্যাপের মতো আন্তর্জাতিক পোশাকব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা যারা বাংলাদেশে থেকে লাখ লাখ ডলারের পোশাক কেনে তাদের দোষারোপ করা হয়। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতলা তুলে ধরা হয় এ ধরনের বিপর্যয় সত্ত্বেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সম্পাদকীয় পর্ষদ জানিয়েছে, দেশের ৩৬ লাখ পোশাক শ্রমিকদের জন্য কার্যকরী পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে হাসিনার। এজন্য প্রথম করণীয় হিসেবে, বাংলাদেশের শ্রম আইন ও নিরাপত্তা মান কার্যকর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও আইন থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ার বিষয়টিও সম্পাদকীয়তে উঠে এসেছে।
৩০ মে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ জিএসপির নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিশেষ ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বিভিন্ন শ্রমঅধিকার গোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর থেকে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিচ্ছে। খোদ মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা মত দিয়েছেন জিএসপি সুবিধা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে। বাংলাদেশের আগুন ও ভবন নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষ করে ইউরোপীয় পোশাক ক্রেতা কোম্পানিগুলো যে চুক্তি করেছে সেসম্পর্কে প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে নিউইর্য়ক টাইমস। ‘বাংলাদেশের কারখানা নিরাপত্তা চুক্তিতে বড় ধরনের ঝুঁকি দেখছে মার্কিন খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলো’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ওয়ালমার্ট, গ্যাপসহ প্রধান প্রধান মার্কিন খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর চুক্তি সই না করার অনাগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ওই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা গুলোর কাজের পরিবেশের মান উন্নয়নসহ নিরাপত্তা বাবদ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ মার্কিন ডলার দিতে হবে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানিগুলোকে। ব্রিটেনের প্রাইমার্ক, কানাডার লোব্ল, ফ্রান্সের ক্যারাফোর, সুইডেনের এইচঅ্যান্ডএম ইত্যাদি কোম্পানি সই করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র দুটি ছোট কোম্পানি ছাড়া আর কেউ সই করেনি।
শ্রম আইনে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতন ও কাজের পরিবেশ নিয়ে দর কষাকষির বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের এসব অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজ করে না। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইতিহাস বলে যে কাজের পরিবেশের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। শক্তিশালী ইউনিয়নের মাধ্যমে আটতলা বিশিষ্ট রানা প্লাজার ধস হতাহত কমানোর যেত। পোশাক কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াটা হাসিনা সরকারের পক্ষে সহজ হবেনা বলেও মন্তব্য সম্পাদকীয় পর্ষদের। কেননা পোশাক কারখানা মালিকরা পার্লামেন্টের ১০ শতাংশ সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ২০ মে শিরোনাম করে-‘বাংলাদেশের ট্র্যাজিডি ও বাণিজ্য’। ওই প্রতিবেদনে ধসে যাওয়া ভবন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও বাংলাদেশের আইনের ফাঁক-ফোকড় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ১৭ মে আরেকটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ওপর থেকে জিএসপি সুবিধা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের মনোভাবের কথা তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো কাজের পরিবেশের মান উন্নয়নে চাপ সৃষ্টি করতে আমদানি করা নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মোদির বরাত দিয়ে ৭ মে পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে’। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতি অস্থিরতা, সহিংসতা, হরতাল-ধর্মঘটকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ওয়াশিংটন ডিসির সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট ভবন ধসের ঘটনাটিকে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্ধকার ঘনীভূত হলো’ বলে অভিহিত করেছে। ২৭ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ’স ইকোনোমিক আউটলুক ডারকেন্স আফটার ফ্যাক্টরি কলাপস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রানা প্লাজা ধসের আগেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বিরোধীদের দ্বন্দ্বের কারণে সমস্যায় ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-ধর্মঘটে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়া পোশাক শিল্পের ক্ষতকে আরও বাড়িয়ে দেয় সাভারের আটতলা ভবনের ধস।
১ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে-এমন চিত্র তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ যে সুযোগ ভোগ করে তা সীমাবদ্ধ করার কথা বিবেচনা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ১৭ মে এক পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল-‘বাংলাদেশের ওপর থেকে শুল্ক সুবিধা তুলে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র’। পত্রিকাটি মতামত পাতায় হ্যারল্ড মেয়ারসন নামে এক ব্যক্তির একটি মতামত ছাপায়। ওই পাঠকের লেখায় যুদ্ধাঞ্চলের পরেই বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকের কাজের পরিবেশকে বিপজ্জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
Leave a Reply