জুয়েল রাজ: বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন থামেনি, নীরব নির্যাতন এখনো চলছে। বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভ এর বুরুঙ্গা গণহত্যা দিবস উদযাপনে গাফফার চৌধুরী বলেন ১৯৭১ শালে পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তাঁর ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে এখনো প্রতিনিয়ত নীরবে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চলছে আর তা আওয়ামী লীগের নামধারীরাই চালিয়ে যাচ্ছে এখন।
উদাহরণ হিসাবে সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করেন তিনি। গাফফার চৌধুরী আরো বলেন এর দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আর যাবার কোন জায়গা নাই। ভারতের মতো হিন্দু মহাসভা বা ভারতের মুসলমান নেতৃত্বের মতো কোন শক্তিশালী নেতৃত্ব ও নেই। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্ঠান ঐক্য পরিষদ নামে একটা সংগঠন ছিল যা এখন একটা নপুংসক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে হিন্দু মুসলিম সবাই নির্যাতিত হয়েছে
কিন্তু তুলনামূলক ভাবে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়েছে বেশী। দেশের স্বার্থে হিন্দুদের ঠিকিয়ে রাখতে হবে। গাফফার চৌধুরী বলেন সাধারণ মানুষের অনুভুতিকে কাজে লাগাতে দেশজুড়ে হিন্দু সম্পত্তি মসজিদ মাদ্রাসার নামে দখল করে নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। যারা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করছে।
শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন মুক্তিযুদ্ধার তালিকা আছে প্রতিনিয়ত সংযোজন বিয়োজন হচ্ছে কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরে ও রাজাকারের কোন তালিকা তৈরী করা হয়নি। এই সুযোগে এদের উত্তর সূরী রা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করছে। তাই রাজাকারের তালিকা ও এখন পর্যায়ক্রমে করা হবে।
সভাপতি তাঁর সমাপনি বক্তব্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মে গণহত্যার স্মৃতিচারণ করে বলেন আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম আমার চোখের সামনে বুরুঙ্গার সেই বীভৎস ঘটনা ঘটেছে , আমার দুইজন শিক্ষক সহ গ্রামের প্রায় একশত লোককে সেদিন নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ক্ষোভের বিষয় এই সব রাজাকার আলবদরের সন্তান রা এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য আওয়ামী লীগকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য এখনি শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। বুরুঙ্গার মানুষ না হয়ে ও আপনারা আমার গ্রামের নিহত শহীদদের স্মৃতির প্রতি যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
গতকাল ২৮শে মে পূর্ব লন্ডনের হ্যানবারি ষ্ট্রীটে বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভ এর উদ্যেগে পালন করা হয় বুরুঙ্গা গণহত্যা দিবস। বুরুঙ্গা গ্রামের সাবেক মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা সুরমান আলীর সভাপতিত্বে ও প্রজন্ম ৭১ এর সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসাইন এর পরিচালনায়
এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য সাংবাদিক কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, প্রধান বক্তা ছিলেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বালাগঞ্জ বিশ্বনাথের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযুদ্ধা সুলতান শরীফ।
বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভ এর পক্ষে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইঞ্জিনিয়ার সুশান্ত দাস গুপ্ত। অন্যান্যদের মাঝে বক্তব্য রাখেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পুষ্পিতা গুপ্তা, আনহার মিয়া ব্যারিষ্টার শওগাতুল আনোয়ার খান সহ আরো অনেকে।
বুরুঙ্গা গণহতার হৃদয় বিদারক কাহিনীতে জাণা ্যায় ১৯৭১ সালের ২৫মে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা বুরুঙ্গায় প্রবেশ করলে চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় স্থানীয় চেয়ারম্যান ইনজেদ আলী লোক মারফত এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করেন পাকবাহিনী কারো ক্ষতি করতে আসেনি। ঐদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে এলাকায় বৈঠক করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন (২৬মে) শান্তি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সভা করা হবে । সভায় সকলকে শান্তি কার্ড দেয়া হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয় সভায় সকলের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে সভায় উপস্থিতির জন্য গ্রামে জোর প্রচারণা চালায়।
২৬ মে সকালে মৃত্যু ভয় নিয়েও অনেকে বিদ্যালয় মাঠে এসে উপস্থিত হয়। সকাল ৯টার দিকে রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), গৌছ মিয়া ডা. আব্দুল খালিকসহ পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানী সেনা জীপে চড়ে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমান ইকবাল আহমদ হাই স্কুল এন্ড কলেজ) অবস্থান নেয়। প্রথমে তারা তাদের পূর্বকল্পিত নকশা অনুযায়ী সবার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এসময় পাক হানাদারদের একটি দল গ্রামে ঢুকে পুরুষদের মিটিং-এ আসার তাগিদ দিতে থাকে।
সকাল ১০ টায় বিদ্যালয় মাঠে সমবেত লোকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করা হয়। এসময় পাক বাহিনী তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে কয়েকশ’ মুসলমানকে কলেমা পড়িয়ে এবং পাকিস্তানের স্লোগান দিয়ে ছেড়ে দেয়। হিন্দুদের বিদ্যালয়ের অফিসকে ও অবশিষ্ট মুসলমানদের দক্ষিণ দিকের একটি শ্রেণী কে রাখা হয়। পাকবাহিনী তাদের জিম্মায় থাকা মুসলমাদের নির্দেশ করে ৪ জন করে হিন্দুকে এক সাথে বাঁধার জন্য। এসময় গ্রামের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এটা ইসলাম বিরোধী কাজ। এখানে হিন্দুদের দাওয়াত করে আনা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন চেয়ারম্যানকে ধমক দিলে তিনি নিরব হয়ে যান। হিন্দুদের যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল; একটি জানালা শ্রী নিবাস চক্রবর্ত্তী কৌশলে খোলে ফেলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবেন, কিন্তু পারেননি। এক সময় ঐ খোলা জানালা দিয়ে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রীতি রঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার নামের এক যুবক পালানোর উদ্দেশ্যে লাফ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন।
এসময় পাক সেনারা তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। ভাগ্যক্রমে দু’জনই নিরাপদ দুরত্বে চলে যেতে সম হন। দুপুর ১২ টার দিকে পাক সেনারা প্রায় শতাধিক লোককে বাধা অবস্থায় বিদ্যালয়ের মাঠে এনে ৩টি এলএমজির সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন উপস্থিত সবাইকে মুজিব বাহিনীর দালাল আখ্যায়িত করে বলে- এখন তোমাদের কি করবো তোমরাই বলো!
তখন রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া) ও আব্দুল খালিক ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে বলে, এরা সকল মুজিবের সমর্থক, এদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়। তখন ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের সামান্য ইশারায় এলএমজিগুলো এক সাথে গর্জে উঠে। মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে সবুজ মাঠ, নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবগুলো দেহ। পাক বাহিনী গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুরুঙ্গা বাজার থেকে ২টিন কেরোসিন এনে লুটিয়ে পড়া দেহগুলোর ওপর ঢেলে আগুন দেয়। তৎকালীন সিলেট জর্জ কোর্টের উকিল রাম রঞ্জন ভট্টাচার্য্যকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এসময় তাকে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করে।
মানুষের অত্মচিৎকারে চারিদিক যখন প্রকম্পিত রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), আব্দুল খালিকসহ আট-দশজন পাকিস্তানী তাবেদার তখন সমস্ত গ্রামে লুটপাট ও নারী নির্যাতনে মগ্ন হয়। পাক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে একাধিক গুলি খেয়েও ভাগ্যক্রমে কয়েকজন বেঁচে থাকা কয়েকজন এসময় পালিয়ে যেতে সম হয়।
সমস্ত দিন-রাত পোঁড়া, অর্ধপোঁড়া লাশ গুলি একই জায়গায় পড়ে রইল। পরদিন সকালে আবার কিছু পাকিস্তানী সৈন্য বুরুঙ্গায় এসে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কিছু লোক চেয়ে নিয়ে মৃত দেহ গুলোকে বুুরুঙ্গা স্কুলের পাশে (বর্তমান গণকবরে) একটি গর্ত খুঁড়ে মাটি চাঁপা দেয়। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজ ও তাড়া করে বেড়ায় বুরুঙ্গা তথা বালাগঞ্জের মানুষকে।