ড. মুকিদ চৌধুরী: মে ২০১৫ এর ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনে কী ঘটেছিল তা ভুলে যাওয়ার আগে আগ্রাহি দৃষ্টিভঙ্গিতেভোটের ফলাফলের প্রতি মনোযোগ দেওয়া কর্তব্য। আমি বলতে চাচ্ছি না যে, রক্ষণশীল টরি-পার্টিই জিতেনি, বরং কিভাবে জিতেছে তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। রক্ষণশীল টরি-পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় অনেকেই শুধু আশ্চর্যই হননি, বরং আতঙ্কগ্রস্তও হয়েছেন বটে।
একই সঙ্গে শ্রমিক-দলের নেতা এড মিলিব্যান্ডের গ্রহণযোগতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে আবার দাবিকরছেন যে, রক্ষণশীল টরি-পার্টির জয় এই প্রমাণ করছে যে, ইংরেজ-জাতি মূলত একটি রক্ষণশীলজাতি। অন্যারা মতপ্রকাশ করতে দ্বিধা করছেন না যে, শ্রমিক দলের পরাজয় ও ব্যর্থতাশুধু ব্রিটেনের জন্যই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের সঙ্কটকেই প্রতিনিধি করছে। তার পর চলেছে পক্ষে ও বিপক্ষের তথ্য-তত্ত্ব প্রদান।
আমি সেই তর্ক-বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে শুধু আলোচনা করতে চাই যে, কিভাবে ডেভিড ক্যামেরন তার রক্ষণশীল টরি-পার্টিকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দিয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন।
আমরা কয়েকদিন আগে রাণীর দেওয়া ভাষণে (ডেভিড ক্যামেরনের লেখা আর রাণীর মুখেপ্রচারিত) একটি সংরক্ষণশীল সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো সম্বন্ধে অবগত হলাম; এরকমপাঁচ বছর মেয়াদী রক্ষণশীল কাঠামো প্রদানে অবশ্য সচেতন নাগরিকরা আশ্চর্য হননি। জানাগেল, একটি রক্ষণশীল কিন্তু বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আসছে; শীঘ্রই একটি রক্ষণশীলবাজেট পেশ করা হবে; রক্ষণশীল আইন তৈরি করা হবে; ইত্যাদি;
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, সচেতন নাগরিগরা এ-সম্বন্ধে কোনও উচ্চবাক্য করছে না, এ-কে-ই হয়তো বলে ব্রিটিশরক্ষণশীল নির্বাচনী ব্যবস্থা; তবে এও ধ্রব সত্য যে, রক্ষণশীল টরি-পার্টি কোনও অবস্থায়ই,কোনও স্বাভাবিক সংজ্ঞা দ্বারা তো অবশ্যই নয়, গত সাধারণ নির্বাচনে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।মূল ভোটের মাত্র ৩৬.৯% ভোট পরেছে রক্ষণশীল টরি-পার্টির পক্ষে। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার দিক থেকে, সংখ্যালঘু ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করেছে রক্ষণশীল টরি-পার্টি।
অর্থাৎ কোন স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সংজ্ঞা দ্বারা তারা সম্পূর্ণরূপে তাদের ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়নের রায়পায়নি। অর্থাৎ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের ভোট পরেনি সংরক্ষণশীল টরি-পার্টির বাক্সে। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ ভোটা তাদের ভোট-বাক্সে পরেছে মাত্র। আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না যে, গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা ব্রিটেনের সংসদের (হাউস অফকমন্স)-এর অর্ধেকের চেয়ে বেশি আসন দখল করে নিয়েছে এক চতুর্থাংশ ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের ভোটে। শুধু কী তাই, বরং সংখ্যালঘু ভোটে জয়ী রক্ষণশীল টরি-পার্টিআগামী পাঁচ-বছর রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করে (পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য) সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণশীল কর্মসূচির মাধ্যমে দেশ সাশন ও শোষণ করে যাবে।
অন্যদিকে, ব্যাপকভাবেবিজয়ী ও সুবিধাপ্রাপ্ত ‘স্কটিশ জাতীয়তাবাদী পার্টি’-এর সদস্যরা সশব্দে সংসদে প্রবেশ করে,রক্ষণশীল টরি-পার্টির করতালির মাধ্যমে, সংসদের বিরোধী দল ‘শ্রমিক-দল’-এর নির্দিষ্টআসন দখলের প্রতিযোগিতায় কোমর-বেঁধে রণে লেগে পড়েছে। আর এই ব্রিটিশ নেতারা,আমলারা বাংলাদেশের মতো একটি নব-গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন ও সংসদের কর্মকাণ্ডনিয়ে কট্টাক্ষ করে, আসে সবসময়, তারাই এখন কোনও কথা বলে না। সভ্য-জাতিরসভ্য-সংসদে যা সহজে করা যায় তা হয়তো ব্রিটিশ তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ বিশ্বের সল্প-শক্তিশালী দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
একেই হয়তো বলে দু’মুখো সাপ। তবে এও সত্যযে, ব্রিটিশ সংসদে এখন তৃতীয় বৃহত্তম দলটি হচ্ছে ‘স্কটিশ জাতীয়তাবাদী পার্টি’, যদিও৫০% স্কটিশরা তাদের পক্ষে ভোট প্রদান করেননি, কারণ তারা মনে করেন যে, স্কটিশস্বার্থরক্ষায় এই দলটি সফলভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে অক্ষম। এই দলই এখন স্কটল্যান্ডের ৫৯সাংসদের ৫৬জন রয়েছেন। অন্যদিকে, এক মিলিয়ন ভোট বেশি পেয়েও মধ্যপন্থী লিবা. ডেম. পার্টির অস্তিত্ব ব্রিটিশ সংসদে প্রায় নেই বললেই চলে;
যদিও তাদের পক্ষে ভোট পড়ে ২,৪১৫,৮৬২ তবুও হারিয়ে ফেলেছেন তাদের প্রভাবশীল অনেক নেতা। যদি গণতান্ত্রিকভাবে ব্রিটিশ রাজনৈতিক পদ্ধতিতে প্রতিটি জনগণের রায়, মূল ও প্রভাব সমানহত তাহলে এই দলের কমপক্ষে ৫১জন সাংসদ থাকতেন এই সংসদে। তবে বাস্তবে ব্রিটিশরাযতই গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল বলে চিৎকার করুক না কেন, নিজভূমিতে কিন্তুঅগণতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যায়। ব্রিটিশ নির্বাচনী পদ্ধতিতে আরো একাধিক বিকৃতি প্রভাব রয়েছে।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে তথাকথিত গণতান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ দুর্দান্ত অনুপাতহীন ভাবে সংসদের আসন বণ্টন করা, যাজনগণকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না, যা শুধু বছরের-পর-বছর তথাকথিত রাজনৈতিক যুক্তি দ্বারা আকড়ে রাখা হয়েছে। আর তাই লিবা. ডেম. পার্টির প্রতিনিধিত্ব নেই বলেই চলে,যদিও তারা স্কটিশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ে বেশি জনগণের ভোট পেয়েছেন। গণমাধ্যমেওউদয় হবে স্কটিশ জাতীয়তাবাদীর তর্ক-বির্তক ও বিকাশ। পরিবেশপন্থী ‘সবুজ দল’টিও এক মিলিয়নের বেশি সমর্থন পেয়েছে, যা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে,তবুও জনগণের সমর্থন অনুযায়ী গণপ্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেনি এই সংসদে।
তাই এই ব্রিটিশ দাপটি গণতন্ত্রের শিকার হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তর আইল্যান্ড ডেমক্রেটিক ইউনিয়ন মাত্র১৯০,০০০-এর চেয়ে কম ভোট পেয়ে আটজন সাংসদ নিয়ে সংসদে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের কারণে অবিশ্বাস্য ওসবচেয়ে বাজে অবস্থায় আছে ‘ইকিপ’ (Ukip) দলটি। চারমিলিয়ন ভোট পেয়েও এই দলের পক্ষে মাত্র একজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এ-পদ্ধতিঅবশ্যই, আপনারাও স্বীকার করতে বাধ্য যে-কোনও গণতান্ত্রিক নিয়মে একদম অগণতান্ত্রিকইবটে। আর আপনি যদি ‘ইকিপ’ দলের সমর্থক হন তবে বলতেই পারেন যে, ব্রিটিশ গণতন্ত্র ওসংসদিয় রাজনীতি একটি পচা প্রতিষ্ঠান, বহুদলীয় রাজনৈতিক পরিবেশে এ একেবারে অমানানশীল,
বরং ভেঙে পড়েছে, যুগ অনুপোযোগী, আর তাই এর সংস্কার আবশ্যক। এ করাআরও উচিত এজন্য যে, রক্ষণশীল টরি-পার্টির নীল রঙের বাহারে এখনও যুক্তরাজ্য ছেয়েযায়নি, যদিও অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে, ব্রিটিশ রক্ষণশীলরা সংখ্যায় এখনও কমনয়; তবে ব্রিটিশ নির্বাচনী পদ্ধতির ত্রুটিগুলোকে যদি ছেঁটে-কেটে না ফেলা হয়, তাহলে এইঅগণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল থাকবেই, যা অবশ্যিই অযৌক্তিক এবং ভয়ানক। তাই নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার ও পরিবর্তন করতেই হবে;
যদিও এই সংস্কার ও পরিবর্তন ব্রিটেনেরপ্রধান দুই দলের স্বার্থ রক্ষার করবে, যা পারে শুধুমাত্র এই রক্ষণশীল ও অনেক দিনেরসুরক্ষিত নির্বাচনী ব্যবস্থাই। তাই তারাই প্রথম এই সংস্কার ও পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নেবে, আক্রমণ শুরু করবে, যা করে আসছেই