নিউজ ডেস্ক: প্রতিমাসে একটি করে নিলাম ডাকার কথা থাকলেও ২০১৪ সালের ১২ মে’র পর আর কোনো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি)। ফলে এই ডিপোতে জব্দ থাকা প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পণ্যের মেয়াদ ইতোমধ্যে ফুরিয়েছে।
আরো বিপুল পরিমাণ পণ্যের মেয়াদ ফুরাতে বসলেও এসব পণ্যের নিলামের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। আইসিডির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আর এতে করে কোটি টাকার রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ায় ইতোমধ্যে এই ডিপোতে জব্দকৃত অনেক পণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আবার অনেক পণ্যের মেয়াদ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। কিছু পণ্যের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব মালামালের আর্থিক মূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।
কাস্টমস সূত্র জানায়, দেশের অন্যান্য কাস্টমসগুলোতে প্রতিমাসে কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। বিগত সময়েও এই কাস্টমসে মাসে এক-দুটি নিলাম অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু গত বছরের ১২ মে একটি নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আর কোনো নিলাম হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক চোরাচালানের অভিযোগে আটক পণ্য কাস্টমস গোডাউনে রাখা হয়। এক্ষেত্রে দ্রুত পচনশীল বা অরক্ষণশীল পণ্যসামগ্রী অর্থাৎ যেসব পণ্যসামগ্রী গোডাউনে জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রির ব্যবস্থা না করলে সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হবে সেসব পণ্য গোডাউনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিচার নিষ্পত্তির আগেই দ্রুত নিলাম বা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করবেন।
তবে সোনা, রুপা নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রাসহ মূল্যবান ধাতু অতি দ্রুত নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক আটককৃত শাড়ি, লুঙি, থ্রি-পিস, ওড়না, সোয়েটার, শীতবস্ত্র ইত্যাদি নিলাম ও বিক্রি করার পরিবর্তে মামলার আলামত রেখে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডারে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আধা পচনশীল ও পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। বলা হয়েছে- লবণ, চিনি, ধান, চাল, আচার, সার, হস্তান্তরিত নৌকা বা নৌযানসহ এ জাতীয় পণ্য একটি নির্দিষ্ট দিনে গোডাউনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সরকারি নিলামকারী বা তার প্রতিনিধি বিপুল প্রচারণা করে একাধিক কাস্টমস অফিসে এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরে টেন্ডার বাক্স বসিয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করবে।
এছাড়া ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, ক্রোকারিজ, গার্মেন্টস সামগ্রীসহ অবনতিশীল পণ্য, যা এক মাসের মধ্যে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন পণ্য ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সিল্ড টেন্ডারে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। গুণগত মান হ্রাস পাওয়া লট বা পরপর তিনটি নিলাম সেলে যেসব পণ্য বিক্রি সম্ভব হয়নি সেসব লট অন্য লটের সঙ্গে যুক্ত করে মেগালট তৈরি করে নিলাম শেষ করতে হবে।
আদেশে আরো বলা হয়েছে- পণ্য অবতরণের ৩০ দিনের মধ্যে যেসব লাইন নম্বরের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি নোটিং হয়নি সেসব লাইন নম্বর সনাক্ত করে অনলাইন ম্যানিফেস্টের হার্ড কপি প্রিন্ট করে ম্যানিফেস্টের শাখা তা নিলাম শাখায় নিয়মিতভাবে পাঠাবে।
নিলাম শাখা ওই হার্ডকপি আইজিএম পরীক্ষা করে সেসব সনাক্তকৃত লাইন নম্বরের প্রয়োজনীয় বিস্তারিত বিবরণ একটি রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন এবং সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে বা যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে এই কার্য সম্পাদন করবে। নিলাম শাখা এইসব লাইন নম্বরের আমদানি পণ্য চালানগুলো দ্রুত হস্তান্তরের বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’
কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কা নেই সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ কাস্টমস হাউজে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলামেইলকে বলেন, জব্দকৃত মালামালের ওপর মাসে কমপক্ষে একটি করে নিলাম ডাকার আদেশ থাকলেও তা করা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কর্মকর্তাদের হয়রানির কারণে কমলাপুর আইসিডির রেলপথেও কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে। ফলে অন্যপথে আমদানি পণ্যের জন্য বেশ খরচ গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ পথে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কমেছে ১৩ শতাংশ। কমেছে রাজস্ব আয়ও। তাছাড়া কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্যেও অসহায় হয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
কর্মকর্তারে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গত অর্থ বছরের চেয়ে এ অর্থবছরে রাজস্ব আয় কমেছে ৪৫৪ কোটি ৫৯ টাকা। গত অর্থবছরে এ ডিপোটি থেকে সরকারের আয় হয়েছে ১৩৯৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু এ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৩৮ কোটি ৮১ লাখ টাকায়।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য কমলাপুর আইসিডিতে গেলে কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি। নিলামের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার কাজিয়া সুলতানার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নিলাম ডাকার আগের সব কাজ আমরা শেষ করে রেখেছি। কিন্তু কী কারণে নিলাম ডাকা হচ্ছে না, তা আমাদের জানা নেই। তিনি এক শীর্ষ কর্মকর্তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তার কারণেই সব হচ্ছে। তাছাড়া নারী হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি হন না।
ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর থেকে নিলাম সম্পন্ন করার জন্য ওই কর্মকর্তাকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। একাধিকবার চিঠিও পাঠানো হয়েছে। তার এমন আচরণে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু তিনি তাতেও কর্ণপাত করছেন না।