স্বদেশ জুড়ে: বর্তমান সরকার গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙার যে সুপারিশ করেছে তা রাজনৈতিক বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তাছাড়া সরকারের হাতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোই চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিও ব্যাপক। তাই প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে দেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশে এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের যারা গ্রাহক তারা ঠিকই ঋণ পাচ্ছেন। ঋণ দিচ্ছেন। তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কাজেই সরকারের কর্তৃত্ব এনে এটি পুনর্গঠন করার দরকার নেই। অথচ সরকারের যে রেকর্ড গত ৪০ বছরের, সেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। সরকার যে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়েছে তার একটিও চালাতে পারেনি। সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই এই যে সিদ্ধান্ত এটা আমার কাছে মনে হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সরকার গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে টুকরা টুকরা করার যে পরিকল্পনা করেছে সেটা হবে গায়ের জোরে করা। গ্রামীণ ব্যাংক এমন নয় যে কোন কাজ করছে না। প্রতিষ্ঠানটি তো কাজ করছে। কমিশনের সুপারিশ করা নতুন কাঠামোতে গ্রামীণ ব্যাংক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি সংবিধিবদ্ধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই চালু থাকবে। মালিকানা বিষয় সংক্রান্ত বিকল্প হিসেবে শিল্প ব্যাংকের আদলে বা রূপান্তর করে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারি শেয়ারের অংশ ৫১ শতাংশে উন্নীত করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয়া সুবিবেচনার বিষয় হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি জানান, অতীতে দেখা গেছে যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। তিনি সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নেয়ার পরামর্শ দেন সরকারকে।
গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ পুরোপুরিভাবে অযৌক্তিক। তিনি বলেন, দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে করুণ অবস্থার মধ্যে আছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। কোম্পানি গঠন করার পরও সরকারের নানা ধরনের হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকগুলো চরম সংকটে আছে। এগুলোই চালাতে পারছে না। হিমশিম খাচ্ছে। দুর্নীতিও এসব প্রতিষ্ঠানে প্রবল। আবার নতুন করে ঝামেলা কিনে নিচ্ছে সরকার। তার মতে, কমিশনের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে এর মাধ্যমে আমরা অনেক পিছনে চলে যাচ্ছি। ভুল থাকলে সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু সরকারের ব্যাংকটি ভেঙে ফেলা কিংবা পরিচালনের দায়িত্ব হাতে নেয়া ঠিক হতে পারে না বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, একসময় বেসিক ব্যাংক ভাল হলেও এই সরকারের সময়ে এটিও একটি খারাপ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত। এই অবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংককে পুরোপুরি সরকারি মালিকানা ও পরিচালনায় নেয়া হলে এই প্রতিষ্ঠানও শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব মতামত। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙা সরকারের ঠিক হবে না। প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে দেয়া হোক। যেমন আছে তেমনি থাকুক। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি যদি সরকারের অধীনে থাকতো তাহলে কি নোবেল পুরস্কার পেতো? সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান তো নোবেল পুরস্কার পায়নি? তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের এত নজর কেন? তাই সুশীল সমাজের একজন হয়ে বলতে চাই, ভেঙে টুকরা টুকরা করা সরকারের কাজ হওয়া উচিত নয়।
উল্লেখ্য, পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিগুলোর আদলে গ্রামীণ ব্যাংককে ছোট ছোট স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার বিষয়ে সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন। এর অংশ হিসেবে আগামী ২রা জুলাই এ নিয়ে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কর্মশালার মূল বক্তা। কর্মশালায় কমিশনের পক্ষ থেকে ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কাঠামো: কিছু বিকল্প’ শীর্ষক কার্যপত্র উপস্থাপন করা হবে। সেই কার্যপত্রে মালিকানা বিষয় সংক্রান্ত বিকল্প হিসেবে শিল্প ব্যাংকের আদলে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি শেয়ারের অংশ ৫১ শতাংশে উন্নীত করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ করা নতুন কাঠামোতে গ্রামীণ ব্যাংক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি সংবিধিবদ্ধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই চালু থাকবে। সুপারিশে কমিশন বলছে, এই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর পরস্পরের মধ্যে কোন আইনগত, ব্যবস্থাপনাগত ও আর্থিক যোগাযোগ থাকবে না। এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো স্থানীয় সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। আর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মতো গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় শুধু নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করবে।
এ ছাড়া প্রতিটি মাঠপর্যায়ের সংগঠনকে (প্রতিষ্ঠান) নিবন্ধন করার আইনগত কর্তৃত্ব থাকবে। মাঠপর্যায়ের নির্বাচনের সমন্বয়ে থাকবে প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া সংগঠনসমূহের (প্রতিষ্ঠান) আর্থিক সামর্থ্য ও প্রশাসনিক নিয়োগের বিধিসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা, দেশী-বিদেশী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় রাখাই হবে প্রধান কার্যালয়ের কাজ। নতুন কাঠামোয় মূল বৈশিষ্ট্য: কমিশনের সুপারিশ করা নতুন কাঠামোতে গ্রামীণ ব্যাংকের ছয়টি বৈশিষ্ট্য থাকবে। এগুলো হলো প্রায় পুরোপুরি গ্রামীণ ভূমিহীনদের নিয়ে গঠিত একটি গ্রাহক দল, গ্রাহকদের মুখ্য কেন্দ্রবিন্দু হবেন মহিলারা, নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার থাকলেই পরিচালক নির্বাচনের ভোটাধিকার থাকবে, শেয়ারধারীরাই লভ্যাংশ পাবেন, শেয়ার সরাসরি হস্তান্তর করা যাবে না, শুধু অভিহিত মূল্যে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা যাবে এবং গ্রামীণ ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের গ্যারান্টি দেবে সরকার।
এদিকে, চলতি মাসেই কমিশনের গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দিয়েছে। গত বছরের ১২ই মে সাবেক সচিব মামুন-উর রশীদকে প্রধান করে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ও হিসাববিদ মোসলেউদ্দীন আহমেদ।
Leave a Reply