নিউজ ডেস্ক: স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে সিলেটে আবিষ্কৃত হয়েছে শ’ খানেক বধ্যভূমি। ছোট-বড় এসব বধ্যভূমির সংবাদ উঠে এসেছে পত্রিকায়ও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দু’টি বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বধ্যভূমির এসব স্থান ক্রমশ ভূমিখেকোদের দখলে চলে যাচ্ছে।
বধ্যভূমি দু’টি সিলেটের পারাইরচক লালমাটিয়া ও ক্যাডেট কলেজের পেছনের কাকুয়ারপাড় টিলা এলাকায় অবস্থিত (বর্তমান পর্যটন মোটেল ও পার্ক)।
এ দুই বধ্যভূমিতে দুই সহস্রাধিক মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যার পর গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশি দোসর রাজাকার-আলবদররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ দু’টি বধ্যভূমিতে পড়েছিলো হাজারো মানুষের কঙ্কাল।
সেসব ভয়াল স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শীদের। গণহত্যার পর পাকিস্তানি হানাদাররা যাদের দিয়ে এসব গণকবর খুঁড়তে বাধ্য করেছিলো, এমন চারজন বেঁচে আছেন এখনও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লালমাটিয়ার বধ্যভূমির অদূরে গড়ে উঠেছে জামায়াত নেতাদের মালিকানাধীন দু’টি আবাসন প্রকল্প ‘সোনারগাঁ’ ও ‘লালমাটিয়া’। আর কাকুয়ারপাড় বধ্যভূমিতে গড়ে উঠেছে সরকারি পর্যটন মোটেল ও বেসরকারি একটি বিনোদন পার্ক।
লালমাটিয়া বধ্যভূমি
সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের লালমাটিয়া এলাকায় ছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ও চৌকি। এখানকার সড়ক ও রেলপথের দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ভয়াল সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন স্থানীয় প্রবীণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা।
তারা জানান, সে সময় পাকিস্তানি হানাদারররা শহরের লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়ে এসব গণকবর খোঁড়াতো। একেকটি গণকবরে ১৫/২০ জন করে মুক্তিকামী নিরীহ মানুষকে হত্যা করে কবর দেওয়া হতো। সে সময় প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সারি সারি গণকবরে চাপা দেওয়া হয়েছিল মুক্তিকামী অগণিত বাঙালির মরদেহ। অনেকের মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল সড়কের বাম পাশের কচুরিপানা ভর্তি ডোবায়।
এসব হত্যাযজ্ঞ নিজ চোখে দেখেছেন লালমাটিয়ার পাশ্ববর্তী গোটাটিকর এলাকার বাসিন্দা সুনীতি বালা ঘোষ। সেই ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘দলে দলে মানুষকে মেরে ফেলতে দেখেছি। এখানে অসংখ্য লোককে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। অনেকের মরদেহ রাস্তার বাম পাশে বিশালাকার কচুরিপানার ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছিলো’।
প্রাণ বাঁচাতে স্বামী-সন্তানসহ তিনি চলে যান ভারতের লক্ষ্মীনগর শরণার্থী শিবিরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পর ফিরে এসে অসংখ্য কঙ্কাল দেখতে পান। এসব কঙ্কাল গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি- জানান সুনীতি বালা ঘোষ।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা দফতর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা খুরশিদ মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে তাঁবু টাঙিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলো। শুধু এ অঞ্চলের মানুষই নয়, শহরমুখী লোকজনকে দূর-দূরান্ত থেকে ধরে এনে হত্যা করে গণকবর দিতো তারা। তখন আমরা অন্যত্র যুদ্ধে ছিলাম। যুদ্ধ শেষে ফিরে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল দেখতে পাই।
মকবুল হোসেন বলেন, প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গণকবর। এসব গণকবরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিলো হায়েনার দল। আর তাদের সহায়তা করেছিলো রাজাকার-আলবদররা।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার কুটি মিয়া বলেন, একাত্তরে সিলেটে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা ছিল। এখানে ধরে এনে প্রায় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার বহু বছর পর এখনও এ মাটি খুঁড়লে হয়তো কঙ্কাল পাওয়া যাবে। এ ভয়ে এসব জমিতে ফসল ফলান না কেউ।
এ বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারি বিভিন্ন দফতরে বিভিন্ন সময় দাবি জানানো হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলেও জানান কুটি মিয়া।
কাকুয়ারপাড় বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিলেট ক্যাডেট কলেজে (তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল) ছিলো পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। এখানে নারীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যার পর মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো পেছনের টিলার জঙ্গলে। মানুষের মরদেহ হতো পশুপাখির খাদ্য। পড়ে থাকতো কঙ্কাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরও এসব এলাকায় মানুষের হাড়, মাথার খুলি পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয়রা।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন ইকবাল মনসুর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি।
ইকবাল মনসুর বলেন, বাবা ছিলেন পিডব্লিউডি’র প্রকৌশলী। সেই সুবাদে রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সংরক্ষিত এলাকায় বাস করতাম আমরা। কলেজের পেছনের টিলায় ছিলো তোকমার (এক প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ) বাগান। বন্ধুদের সঙ্গে ওই টিলায় তোকমা সংগ্রহে গিয়ে অনেক বাংকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া মর্টারশেল, হেলমেট, রাইফেল, ম্যাগজিন ভর্তি গুলি ও মাইন দেখতে পেয়েছিলাম। এছাড়া টিলার বিভিন্ন স্থানে মানুষের কঙ্কাল ও মাথার খুলি পড়ে থাকতে দেখেছিলাম সে সময়।
তিনি আরও বলেন, সে সময় এসব মর্টারশেল, গোলা-বারুদ, ম্যাগজিন ভর্তি গুলি কুড়িয়ে এনেছিলাম। খেলার জন্য এগুলো এনে খাটের নিচে জমা করে রাখতাম। পরবর্তী সময়ে বাবা সেসব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বোমা বিশেষজ্ঞ দলের হাতে তুলে দেন। এজন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বাবাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এছাড়া সেনাবাহিনীর বোমা বিশেষজ্ঞ দলকে এনে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া এসব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সেগুলো উদ্ধারের পর ধ্বংস করা হয়।
যেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছিলো সেখানটায় এখন সিলেট পর্যটন মোটেল ও একটি বিনোদন পার্ক হয়েছে। কিন্তু গণকবর সংরক্ষণ বা শহীদদের স্মরণে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি বলেও জানান ইকবাল মনসুর। গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে সেখানে অতি শিগগিরই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর তথ্য সংরক্ষণ করতে গিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে এ দু’টি বধ্যভূমির বিষয়ে জানতে পেরেছি। আগে এগুলোর কোনো তথ্য সংরক্ষণে ছিলো না। সম্প্রতি গণকবর ও বধ্যভূমির একটি তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকায় ৩০টি বধ্যভূমি ও গণকবরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ দু’টি স্থান সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।