মো. জাভেদ হাকিম: ‘কেউ প্রেম করে/কেউ প্রেমে পড়ে/আমার হয়েছে কোনটা/জানে না যে এই মনটা…’ আমি কি বান্দরবানের প্রেমে পড়েছি? সত্যিই আমার উড়ন্ত মনের খবর আমি নিজেই জানি না। কতবার যে বান্দরবান গিয়েছি, তা হয়তো আঙুলের কর গুনে বলতে হবে। এরপরও বান্দরবানের অনেক সৌন্দর্যই অদেখা রয়ে গেছে। পরিকল্পনা ছিল, এবার ভারতের চেরাপুঞ্জি যাব। শেষ মুহূর্তে সবকিছু ভেস্তে গেল। কর্তৃপক্ষ আমার ভিসা দেয়নি। ঈদের পরদিন পাসপোর্ট হাতে পেয়ে কিঞ্চিত মনঃকষ্ট নিয়ে সোজা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। হায় খোদা বাসের টিকিটও নেই। অতঃপর টার্মিনাল এলাকার বন্ধু জুবায়েরের দারস্থ হলাম। টিকিট পেলাম মাত্র দুটি। কী আর করা, ভ্রমণে আমার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যার খুনসুটি হয়, সেই নাসির উদ্দিনকে (কচি) সঙ্গে করে যাত্রা শুরু। ত্বরিত সিদ্ধান্ত হলো, এবারের ভ্রমণ বান্দরবানের নাফাকুম। ভোর চারটা পঁচিশ মিনিটে বান্দরবান পৌঁছালাম। পথে জানলাম প্রশাসন পর্যটকদের নাফাকুম যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। তাই গন্তব্য জাঁদিপাই। বেসরকারি ট্যুর অপারেটর একটি প্রতিষ্ঠানের আবু বক্কর সিদ্দিক ভাইয়ের সঙ্গে জোট বেঁধে চান্দের গাড়িতে সোজা কাইক্ষ্যংঝিরি। তারপর ট্রলারে চেপে সাঙ্গু নদের হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে রুমা বাজারে এসে পৌঁছলাম। নতুন সাজে সজ্জিত আরন্যক রিসোর্টে উঠলাম। রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী সদালাপি জসিম উদ্দিন বান্দরবান ভ্রমণে উনিই সহযোগিতা করে থাকেন। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি একজন দক্ষ গাইড মো. নূরুল ইসলামকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন। হাতে সময় থাকায় সেদিনই আর্মিক্যাম্পে নাম ঠিকানা এন্ট্রি করে চান্দের গাড়িতে রওনা হলাম। পাহাড়ি সর্পিল পথে গাড়ি হেলে-দুলে প্রায় দু’ঘণ্টা পর পর্যটকদের নামিয়ে দিল কমলা বাজার। এবার শুরু হলো বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে বগালেক পানে। কখনও গভীর গিরিখাতে, কখনও বিস্তৃত নীলিমার দিকে, কখনও আবার ঢেউতোলা পাহাড়ের সবুজ গালিচায় চোখ বুলাতে বুলাতে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরই পৌঁছে গেলাম উঁচুতে অবস্থিত প্রকৃতির অপার দান বগালেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা দুই হাজার সাতশ’ ফুট। আর্মি ক্যাম্প থেকেই এর সৌন্দর্য দেখে মনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। আর দেহের ক্লান্তি স্বচ্ছ টলটলে জলে ডুব দিলে এক নিমিষেই দূর। দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটলেও মন ভরবে না। আদিবাসী বম মি. কিমের কাছ থেকে জানা গেল, বগালেক নিয়ে যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুতরাং মন ভরে ডুবসাঁতারে মাতিয়ে রাখুন নিজেকে। বগালেকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আদিবাসীদের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে আবারও হাঁটা শুরু হল কেওক্রাডং পাহাড়ের উদ্দেশে। জাঁদিপাই ঝরনায় যেতে হলে কেওক্রাডং গেস্টহাউসে রাতযাপন করতে হবে। এর আগে যখন কেওক্রাডং গিয়েছিলাম, তখন চান্দের গাড়িতে সরাসরি গিয়েছিলাম। এবার হেঁটে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশের দ্বিতীয় উঁচুতম পাহাড় কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা তিন হাজার একশ’ বাহাত্তর ফুট। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে যখন হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই সাভারের সাইফুলের কথা মনে করে নবোদ্যমে হাঁটতে শুরু করেছি। পোলিও রোগে এক পা হারানো সাইফুল হেঁটে কেওক্রাডং ট্র্যাকিং করেছিল, তাহলে আমি পারব না কেন? সত্যিই সাইফুল ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়ে অনন্য দৃষ্টান্ত। গরম যখন অস্বস্তি লাগছিল, তখন শুভ্র মেঘের মালা শরীরে আছড়ে পড়ে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। দিনের শেষে রাত হলো। ভরা জোছনার আলো সম্বল করে বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি বীরদর্পে। মাঝে মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণ-পাগলুদের সঙ্গে হায়-হ্যালো হচ্ছে। আমরা যারা প্রকৃতিপ্রেমী, ঘুরতে গিয়ে ভয়কে জয় করে দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল চষে বেড়াই, তাদের অধিকাংশ পরিবার থেকেই পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সত্যিই তো ভ্রমণপিপাসুরা পাগল। তা না হলে কি জীবনের মায়া ত্যাগ করে পারিবারিক মায়া ভুলে গিয়ে ভ্রমণে বের হয়ে যাই অজানা-অচেনা কোনো পাথুরে পাহাড় কিংবা গহিন বন-জঙ্গলের পথে! মনে পড়ে, একবার সাজেক ভ্যালি যাওয়ার সময় বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্প অনেক করে বোঝানোর পরও আমাদের ফেরাতে পারছিলেন না, তখন সাদা কাগজে লিখতে বলছিলেন—আমাদের মৃত্যুর জন্য বাংলাদেশ সরকার দায়ী নয়। আনন্দ চিত্তে যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন কাগজ টেনে নিয়ে সেনাবাহিনী সদস্য বললেন, ভালোভাবে ঘুরে আসুন। পাঠক বুঝতেই পারছেন, আমরা ভ্রমণপিপাসুরা কেমন পাগল। সময় সাতটা চল্লিশ মিনিট। দার্জিলিংপাড়ায় এসে হাজির। সাময়িক বিরতি নিয়ে চা-নাস্তার পর্ব হলো। এরপর আবারও হাঁটা শুরু। চারদিকের শুনশান নীরবতা খান খান করে চাঁদ মামা যেন অট্টহাসি হেসে বলছে—তোমারা আসবে বলেই তো আজ আমি পূর্ণতা পেয়েছি। তোমাদের পথচলায় আলো ছড়াচ্ছি। জনবসতিহীন, বিদ্যুত্হীন, দুর্গম পাহাড়ি পথে জোছনা রাত যে কত সুন্দর, কতটা মায়াবী, তা শুধু সরেজমিনের ভ্রমণপিপাসুরাই উপলব্ধি করতে পারে। রাত আটটা পনেরো মিনিটে হাজির হলাম কেওক্রাডং পাহাড় চূড়ায়। কটেজের প্রতিষ্ঠাতা লাল বম উষ্ণা অভ্যর্থনা জানিয়ে রুম দেখিয়ে দিলেন। রাতের খাবার শেষে পরের দিনের জন্য চটজলদি ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব সকালে পাহাড়ি মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল। গাইড রেডি, আমরাও রেডি। তারপরও জাঁদিপাই ঝরনার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করতে সাতটা দশ বেজে গেল। এবারের পথ যেন আরও রোমাঞ্চকর, আরও বেশি দুঃসাহসিকতার—এককথায় অ্যাডভেঞ্চার কানায় কানায় পূর্ণ। এরই মধ্যে জোঁক বাবুজি কচির দেহ থেকে কয়েক দফা রক্ত চুষে নিয়েছে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়—বেচারি জোঁককে বেশি ভয় পায়, আর সেই জোঁক কিনা ওর দেহেই বেশি জড়ায়। দেখা পেলাম পাহাড়ি সবুজ রঙের গাল চোকা সাপের, হিংস্র বন্য শূকর, বিষাক্ত চেলা—এসবই তুচ্ছ মনে হয়, পথ চলতে চলতে যখন কানে ভেসে আসে পাহাড়ি ছড়া, ঝিরি আর ছোট-বড় ঝর্নার রিমঝিম শব্দ। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। অন্য রকম এক শিহরণ। জাঁদিপাই পাড়া এসে খানিকটা বিশ্রাম। সদ্য গাছ থেকে পাড়া কমলা লেবু আর ভুট্টা ভাজা খাওয়ার স্বাদ মনে থাকবে অনেক দিন। আবারও সর্পিল পথ চলা শুরু, এবার শুধু নিচের দিকেই নামছি, ঘণ্টা দেড়েক গিরিখাতে নামতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ওয়াও! এত সুন্দর আর এত বড় ঝরনা আগে কখনও দেখিনি। এতদিন রংধনু আকাশেই দেখতে পেতাম, কিন্তু জাঁদিপাই এসে দেখি অনবদ্য ঝরনার পানিতে রংধনুর সাত রঙ। বম সম্প্রদায়ের যুবক লেমনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, জাঁদিপাই মারমা শব্দ। কিন্তু এর বাংলা অর্থ সে জানাতে পারেনি। বলতে না পারলে কী হবে, আমরা এর বাংলা নাম ঠিকই দিয়ে দিলাম; আর তা হচ্ছে জাদু পাই…। আশ্চর্য রকম আর অদ্ভুত সুন্দর জাঁদিপাই ঝরনায় সত্যিই জাদু আছে। বিশাল এই ঝরনার আকার, আকৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটককেই কোনো এক মায়ার জাদুতে জড়িয়ে ফেলবে। প্রকৃতির আপন খেয়াল জাঁদিপই ঝর্নার অপার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি একটু নজর দেয়, তাহলে ভারতের রকগার্ডেনের চেয়ে এর আকর্ষণ কম হবে না। দীর্ঘক্ষণ ঝরনার জলে ভিজে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জলাশয়ে সাঁতার কেটে ফের ইট, কাঠ আর উত্তপ্ত পিচকরা রাজপথ ঢাকামুখী যাত্রা। ফিরতি পথে কেওক্রাডং বিরতি, অতঃপর রাতে দার্জিলিংপাড়ায় লালজাই বমদের কুটিরে আশ্রয়। পায়ের পেশির ব্যথায় যখন অস্থির, তখন পরম মমতায় লাল জাইরের গরম পানি এগিয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। দার্জিলিংপাড়া সারাবছরই তুলনামূলক ঠাণ্ডা থাকে। তার প্রমাণ পেলাম রাতে তিন কম্বল মুড়ে ঘুমানো। পরের দিন সকাল দশটায় বগালেকে নাস্তাপর্ব অতঃপর দৌড়-ঝাঁপ করে রুমা বাজার থেকে শেষ ট্রলারে চড়া। এক সময় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুরা একে অন্যের হয়ে যাওয়া। মনে হয়েছে যেন সবাই একসঙ্গেই আসা। আবেগঘন বিদায় নিয়ে চান্দের গাড়ি থেকে মিলন ছাড় নেমে পড়লাম। আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন লেদুরাম বাহাদুর। রাত নয়টায় বাস। তাই খানিকটা সময় তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ, সেই সঙ্গে অন্ধকারে ঝিরির পানিতে গোসল করে ভ্রমণের ষোলোকলা পূরণ হলো। রাতে বৌদ্ধদের ধর্মীয় উত্সব ফানুস উড়ানো দেখে সোজা ঢাকাগামী বাসে। ভারত ভ্রমণের ভিসা পাইনি, তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু একুশ বছর ধরে ভ্রমণ করে যেসব শখ মেটাতে পারিনি, তার সবই এবার জাঁদিপাই ভ্রমণে মিটেছে। এ এক বিশাল প্রাপ্তি। ভ্রমণের ইতিহাসে যোগ হয়েছে আরও বেশি অভিজ্ঞতার বাণী। ভ্রমণপিপাসুদের যারা পাগল বলেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই—আমরা ভ্রমণ পাগলাটে হয়েছি বলেই তো আজ দেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে সরকারের সুড়সুড়ি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের অনেকেই পাগল বলত, কিন্তু আজ সেসব পাগলই বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার এবারের লেখা উত্সর্গ করছি বান্দরবানের থানচিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ভ্রমণপিপাসুদের উদ্দেশে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প একসময় বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে—সে স্বপ্ন নিয়েই আমাদের ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘের দুঃসাহসিক পথচলা।
Leave a Reply