পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলা পরবর্তী তদন্ত ‘দুই কারণে’ আটকে আছে। এ দুই কারণকে ‘চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা উল্লেখ করেছে দুদকের তদন্ত টিম। বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, বিশ্বব্যাংক থেকে দুদকের কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর পর দুদক চলতি সপ্তাহে তদন্তের সার্বিক বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করে।
প্রসঙ্গত: দুইশ ৯১ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু প্রকল্পে বাংলাদেশের সঙ্গে একশ ২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছিল বিশ্বব্যাংক। তবে প্রকল্পের পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠায় সেই চুক্তি ঝুলে যায়। ওই অভিযোগের তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের পর্যবেক্ষক দল দুই দফা বাংলাদেশ সফর করেন। ওই দলের অন্য দুই সদস্য হলেন- হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফা সফরে দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন পর্যবেক্ষকরা। দুদকের সঙ্গে মতৈক্য ছাড়াই ঢাকা ছাড়েন বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক ওকাম্পোর দল।
গতমাসে কানাডায় দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক ও এ ঘটনায় গঠিত দুদকের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা মির্জা জাহিদুল আলম কানাডায় গেলেও কার্যত শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন। কমিশন এ দুটি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য একজন কমিশনারের নেতৃত্বে দুদকের একটি টিম কানাডায় যাওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, “তদন্ত চলছে। চার্জশিট দেওয়ার জন্য দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজন। এ সব প্রমাণাদি থাকলেই আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা সহজ হয়। তিনি বলেন, কোনো নিরপরাধী যেন আসামি না হয়, আবার কোনো অপরাধী যেন রেহাই না পান, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক।
কমিশন (চেয়ারম্যানসহ দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তা) এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে জানতে চান, মামলা পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন ও চার্জশিট তৈরিতে এ মূহুর্তে কী কী বাধা রয়েছে?
তদন্ত কমিটি কমিশনকে জানায়, এ মূহুর্তে দুটি কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে প্রথম কারণ- দুদকের মামলার আসামি এসএনসি লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার ডায়েরির কোনো কপি না পাওয়া; দ্বিতীয়ত- বিদেশি তিন আসামিকে (রমেশসহ, ইসমাইল ও কেভিন ওয়ালস) জিজ্ঞাসাবাদ না করতে পারা। তদন্ত টিম কমিশনকে জানায়, যার ডায়েরিতে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ তৈরি করা হয়েছিল, কানাডায় গিয়েও তা হাতে না পাওয়ায় এবং বিদেশি আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ না করতে পারায়, তদন্তের অগ্রগতি হচ্ছে না।
পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় (মামলা নং ১৯) মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার আসামিরা হলেন- সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল। তবে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আবুল হাসান চৌধুরীকে মামলার সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে দুদক। দুই আবুল আসামিদের সঙ্গে কী কী ধরনের যোগাযোগ করেছেন তা মামলার এজাহারে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। পদ্মাসেতু দুর্নীতি মামলায় মোট সাত জন আসামির মধ্যে তিন জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে দুদক। এদের মধ্যে মোশাররফ এবং ফেরদাউস বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। আর দুদকের রিমান্ড শেষে সওজ-এর রিয়াজ আহমেদ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিশেষজ্ঞ দল বিশ্বব্যাংককে এ প্রতিবেদন দেয়। আর গত ১১ জুন বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইয়োহানেস সুট বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দলের তদন্ত প্রতিবেদনটি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তুলে দেন। মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
গত সোমবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দুদকের প্রতিক্রিয়ার পর পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জবাব দেওয়া হবে। এর পরদিনই মঙ্গলবার সকালে অর্থমন্ত্রীর কাছে দুদক চেয়ারম্যান এ প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানান। এ দিন রাতে বিশ্বব্যাংক তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুদকের তদন্ত অস্বচ্ছ ছিল। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি না করার ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কানাডা কর্তৃপক্ষ দুদককে জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের আগে রমেশের ডায়েরির কপি পাওয়া সম্ভব নয়। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, ডায়েরির কপি কানাডার আদালতে। এ বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তা দুদককে দেওয়া সম্ভব নয়।
Leave a Reply