এক আবুলের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু বিসর্জন দিতে হচ্ছে। দুদকে জমা দেয়া মামলার সুপারিশে আবুলের নাম না দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিদায় নিয়েছে বিশ্বব্যাংককের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সাবেক এই যোগাযোগ মন্ত্রীর কারনেই আবার ঝুলে গেল পদ্মা সেতুর প্রকল্প। অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা না করায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করছে না বিশ্বব্যাংক বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সামনে এমনই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি এ্যালেন গোল্ডস্টেইন। পদ্মা সেতুতে ‘দুর্নীতিতে’ জড়িত হিসেবে আবুল হোসেনের নাম এলেও তাকে ‘বাঁচাতে’ দুদক চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিকে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা নিয়ে দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আইনগত মতবিরোধের কথা ইনকিলাবের কাছে স্বীকার করেছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি বলেছেন, দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের বৈঠকে আইনগতদিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচানা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের দেশের আইনগত দিক বৈঠকে বিশ্বব্যাংককের প্যানেল দুদকের কাছে তুলে ধরেছেন। দুদকের আইনও তাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে কি করবে না তা নিয়ে বিশ্বব্যাংককের এই প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি কমিশনে একটি খসড়া প্রতিবেদন দাখিল করেছিলো। কমিশন বিশ্বব্যাংককের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবেদন অনুসন্ধান কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে কমিশনে জমা দিবে। এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নিবে মামলা করা যাবে কি না। মামলা করার মতো আলোচনায় আসেনি কমিশন বলে দুদক চেয়ারম্যান জানান। দুদকের আইন উপদেষ্টা এডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, মামলার ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল হোসেন বাধা নন। তার কারণে যে সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না, এটাও সঠিক নয়। আইনি কিছু বিষয় আছে তা আমরা দেখছি। প্রচলিত আইনেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সঙ্গে আলোচনার পথ বন্ধ হয়নি। আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলার সুপারিশ থেকে বাদ দেয়ার কারণে চলতি সপ্তাহে মামলা করার সিদ্ধান্ত থেকে দুদক পিছিয়েছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এডভোকেট আনিসুল হক পদ্মাসেতু প্রকল্পে যেসব তথ্য-উপাত্ত দুদকের অনুসন্ধান টিম পেয়েছে তা জনসম্মুখে তুলে ধরার দাবি জানান। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় দুদকের সেগুনবাগিচাস্থ প্রধান কার্যালয়ে এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফ্রিংয়ে তিনি এ দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, পদ্মাসেতুর দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের যে আলোচনা হয়েছে তা কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা (গণমাধ্যম কর্মী) জানতে পারবেন। আমি কমিশনের কাছে প্রস্তাব করেছি যেসব দালিলিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তা যেন অনুসন্ধানের পর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। তাহলে মানুষের মনে বিভ্রান্ত কমবে। গতকাল বিকেল ৫ টায় দুদক কার্যালয়ে সাংবাকিদের দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিশ্চিত করেছি, বিশ্বব্যাংককের যে সব বক্তব্য আমরা শুনেছি, সে সব বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী আইনুনাগ ব্যবস্থা নিব। প্যানেল আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে। আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করে শিগগিরই আইনি ব্যবস্থা নেবো। প্যানেলের সঙ্গে দুদকের আলোচনা ঐক্যমত ছাড়াই ভেঙ্গে গেছে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওদের সঙ্গে ঐক্যমতের কোন প্রশ্নই আসে না। ওদের উদ্দেশ্যটা কি, ওদের উদ্দেশ্যটা হলো দুদক যে তদন্ত করছে এবং ভবিষ্যতে করবে সেটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং সম্পূর্ণ কিনা সেটি দেখে বিশ্বব্যাংকে রিপোর্ট করা। বিশ্বব্যাংককের প্রতিনিধি দলের প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত শনিবার রাতে ঢাকায় আসে। সোম-বুধবার পর্যন্ত তারা দুদকের সঙ্গে তিনদফা বৈঠক করে। প্যানেলের অন্য দুজন সদস্য হলেন- হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক প্রধান টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড অফিসের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অ্যাল্ডারম্যান। রাজধানীর নয়া পল্টনে ঢাকা মহানগর বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত গতকাল এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির তালিকা থেকে বাদ দিতে চায়। আর এজন্য বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে। এদিকে গত রোববার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুদক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলে দুদক কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংককের আবাশিক প্রতিনিধি এ্যালেন গোল্ডস্টেইন। গত সোমবার এই প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দুষেছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে। অনুসন্ধান সুত্র মতে, সৈয়দ আবুল হোসেন দুদককে জানিয়েছেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এসএনসি লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে তদবির করেছেন। গত সোমবার দুদকের দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বের হওয়ার সময় সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, আমি কোনো দুর্নীতি করেনি। বিশ্বের কেউ আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারবেনা। পৃথিবীর কেউ বলতে পারবেনা আমি কোনো অনৈতিক কাজ করেছি। এছাড়া একইদিন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেছিলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। কখনো কোনো অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত ছিলাম না। দুদকের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল-জাহিদ, মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, উপ-পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও মির্জা জাহিদুল আলম পৃথকভাবে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে ঘুষ লেনদেন নিয়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ তোলার পরই এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। উল্লেখ্য, পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন। পরে সরকার অভিযোগ তদন্তে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি ফিরে গিয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গৃহীত আইনি পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না হলে আবারও সংকটে পড়বে পদ্মাসেতু প্রকল্প। -দৈনিক ইনকিলাব
Leave a Reply