মাত্র ১৫ দিন বয়সী নবজাত পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে যেন এক স্বর্গীয় প্রশান্তিতে বুঁদ হয়ে আছেন রেশমা কাম্বলে। ২৫ বছর বয়সী রেশমা যেদিন তার ছেলেকে জন্ম দেন সেদিন ম্যাটারনিটি হাসপাতালের দুই নার্স কৌতূহল বশে আবিষ্কার করে ফেলে তার বিশাল লম্বা চুল। অপারেশনের পরে রেশমা যখন স্ট্রেচারে অচেতন হয়ে আছে তখন নার্স দু’জন নিজেদের কৌতূহল ঠেকাতে না পেরে রেশমার ঘন চুলের গোছা খুলে ফেলে। খুলেই যেন পড়ে গেল মহাবিপদে।
একে অন্যের দিকে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কি বা করার ছিল তাদের। চুলের অন্ত খুঁজে পেতে এতটা বেগ পেতে হবে ভাবেননি তারা। তারপর আবার সেই চুল বেঁধে আগের অবস্থায় রেখে দেয়ার প্রচেষ্টা; সে এক যুদ্ধ যেন। নার্সদেরই বা দোষ দেয়া কেন? রেশমার চুলের দৈর্ঘ্য তার উচ্চতার থেকে আরও দেড় ফুট বেশি। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে চুলের গোপনীয়তায় আক্রমণে রেশমা তেমন একটা বিস্মিত হননি। বরং, নার্সদের কীর্তি শুনে হাসির বাঁধ ভেঙে পড়ে তার চোখে মুখে।
এ ধরনের ঘটনা তার সঙ্গে প্রায়ই ঘটে থাকে। হবে নাই বা কেন? ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা তার চুল। রেশমা জানালেন, অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না যে, তার চুল আসল। তবে এখন আর অবিশ্বাস করার কোন রাস্তা নেই। স্বয়ং ডাক্তার সনদ দিয়েছেন রেশমার চুলের ব্যাপারে। কিছুটা সেই সার্টিফিকেটের বদৌলতে সহজেই রেশমার নাম উঠেছে লিমকা বুক অব রেকর্ডসে। রেশমা এখন অফিসিয়ালি ভারতের সব থেকে দীর্ঘকেশী নারী। চুলের দৈর্ঘ্য যখন ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি সেই তখন থেকেই চুল খোলা রেখে হাঁটা-চলা করাটা কিছুটা ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চুল খোলা অবস্থায় হাঁটা-চলা করলে চুল আপন মনেই ঘরের ফ্লোর মোছার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। সেটা ঠেকাতে রেশমাকে দাঁড়াতে হতো চৌকির উপর। তারপরও রেশমার চুল মেজে পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতো। কত বার যে এমন হয়েছে, নিজের চুলের উপর নিজেই পা দিয়ে ফেলেছেন।
কল্যাণ শহরে রেশমার পিত্রালয়ের এক অলিখিত আইন হলো রেশমা সবার শেষে বাথরুমে যাবে। কেননা, রেশমার চুল ধুয়ে পরিষ্কার করতে এক ঘণ্টারও বেশি লাগে। রেশমার মা সুনীতা জানালেন, তাদের পরিবারে লম্বা চুল হওয়াটা বংশগত। সুনীতা ও তার বোনও তাদের যৌবনকালে লম্বা চুল নিয়ে গর্ব করতেন। বয়সের সঙ্গে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে একসময় কমে এসেছে তাদের চুলের দৈর্ঘ্য। রেশমা তার নবজাত শিশুকে যেমনটি আগলে রাখেন ঠিক তেমনিভাবেই আগলে রাখেন তার বংশগত উপহার। শেষ চুল কেটেছিলেন ১২ বছর আগে। রেশমা বললো, আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম এটা কত লম্বা পর্যন্ত বাড়তে পারে। রেশমার বড় ভাই রাহুল আঙরে মজার মজার তথ্য জানালেন।
ছেলেবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় সবার থেকে আগে ঘুম থেকে উঠতো রেশমা যেন চুল বাধার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। প্রথমে লম্বা লম্বা বেণী করার পর বিচিত্র উপায়ে ফিতা দিয়ে পেঁচিয়ে খোঁপা করে তবেই স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতো রেশমা। ক্লাসে শিক্ষকরা রেশমার সঙ্গে কথা বলার সময় অজান্তেই তাকিয়ে থাকতো তার চুলের দিকে। রেশমার চুল নিয়ে ছেলেবেলার যাবতীয় স্মৃতির মধ্যে রাহুলের পছন্দের স্মৃতি এগুলোর কোনটিই নয়। রাহুল সব থেকে পছন্দ করতেন রেশমার চুল ধরে টানতে। বিষয়টা বেশ উপভোগ করতেন বলেই জানালেন তিনি। রেশমার চুল নিয়ে দুষ্টুমি করার বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে সব থেকে প্রিয় কোনটি সেটাও বললেন রাহুল। রেশমা তখন বিড়লা কলেজের ছাত্রী।
রেশমার মনোযোগ অন্য কোথাও রয়েছে এমন সময় সন্তর্পণে তার পেছনে গিয়ে চুলের ক্লিপ খুলে দিয়ে দৌড় দেয়াটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কলেজে। এত বছর পরেও রেশমার চুলের উপর আশপাশের মানুষের আকর্ষণ কমেনি বরং বেড়েছে বলা চলে। আহমেদনগর তার শ্বশুরবাড়িতে রেশমা যতবার চুল আঁচড়াতে বসে, ততবারই জানালায় দর্শকের ভিড় জমে যায়। এক প্রতিবেশী রেশমার চুল দেখে বিমোহিত হয়ে মন্তব্য করেন, রেশমার স্বামী তার চুল দেখেই তাকে বিয়ে করেছে। রেশমার স্বামী সতীশ কাম্বলে অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। এ পর্যন্ত তিনি নাকি শুধুমাত্র চুলের গোছা বাঁধা অবস্থায়ই দেখেছেন। তিনি একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর। তাদের বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে। বিয়ের আগে শুধু রেশমার পাসপোর্ট সাইজ একটি ছবি দেখেছেন তিনি। বিয়ের সময় অতিথিরা ধারণা করেছে রেশমা সম্ভবত অতিরিক্ত পরচুলা ব্যবহার করেছে।
বাইরে চলাচল করার সময় নানা ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন রেশমা। রেলস্টেশনগুলোতে ছোট বাচ্চারা সুযোগ পেলে চুলে একটু হেঁচকা টান দিয়ে দেখে। রেল চলাচল করার সময় কৌতূহলী সহযাত্রীরা একটাই প্রশ্ন করে থাকে, এ চুলের রহস্য কি? আশ্চর্যজনক হলেও অনেক বছর রেশমা তার চুলে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এমনকি হেয়ার ড্রায়ারও ব্যবহার করেননি। বরং, তার অসাধারণ চুলের পরিচর্যা প্রক্রিয়া নিতান্তই সাধারণ। সপ্তাহে একদিন তিনি শিকাকাই সাবান দিয়ে তার চুল ধুয়ে ফেলেন। তারপর চুলে নারকেল তেল দেন। প্রতিবার চুলে তেল দিতে আধা বোতলের বেশি নারকেল তেল লাগে। রেশমা যখন তার চুলের গোছার বাঁধন খুলে দেন তখন সুনিপুণ হাতে পেঁচিয়ে রাখা কেশগুচ্ছ যেভাবে অদ্ভুত ছন্দে ফ্লোর পর্যন্ত পৌঁছে সে দৃশ্য ঠিক যেন টিভির বিজ্ঞাপন।
একবার শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের জন্য রেশমাকে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ না করলেও রেশমা স্থানীয় দীর্ঘকেশ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন দু’বার। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দু’বারেরই জয়ী হয়েছিলেন তিনি। আগ্রহভরে প্রতিযোগিতার ছবির অ্যালবাম দেখালেন রেশমা। ছবি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় বিচারকদের জয়ী নির্বাচন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি কেননা বাকি সবার চুল খুব বেশি হলে হাঁটু পর্যন্ত। রেশমা জানালেন, তিনি তার চুল আরও লম্বা করে যাবেন। রেশমার চুল নিয়ে তো অনেক কিছু তার কাছ থেকে জানা গেল। যার চুল নিয়ে এত মাতামাতি সেই রেশমার কোন ধরনের চুল পছন্দ জানতে চাইলে রেশমা জানায়, চীনা মেয়েদের সোজা লম্বা চুল তার খুব পছন্দ। রেশমার ভাষায় সেটা নাকি জলপ্রপাতের মতো।
Leave a Reply