শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:০৭

রোজা মানে শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট নয়

রোজা মানে শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট নয়

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তামীম রায়হান: সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা, পরিভাষায় যাকে আমরা বলি- রোজা বা সিয়াম পালন- এটাই রমজানের প্রধান আকর্ষণ। এ মাসটির এমন মহিমান্বিত সম্মানের এটাই প্রথম কারণ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রোজার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমলের বিনিময়ে দশগুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহ পাক বলেন, রোজার বিষয়টি ভিন্ন। রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেবো। বান্দা আমার জন্যই তার লালসা-প্রবৃত্তি, তার পানাহার ত্যাগ করেছে। এক রোজাদার বান্দার জন্য দু’টি খুশির উৎসব। একটি তার ইফতারের সময়ের খুশি এবং আরেকটি তার মহান রবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ের আনন্দ। রোজাদার মানুষের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ পাকের কাছে মিশক আম্বরের সুঘ্রাণের চেয়েও বেশি খুশবুময়। (বুখারী, মুসলিম)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, যে মুসলমান ঈমান এবং ধৈর্যের সঙ্গে পূণ্য কামনায় রমজান মাসজুড়ে রোজা রেখেছে, তার অতীত জীবনে কৃত সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম)

এমন অনেক হাদীস থেকে বোঝা যায় যে শুধুমাত্র খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। শারীরিক ভোগ-চাহিদার প্রতি এ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আত্মিক আচার-আচরণেও এ রমজানের নির্দেশনা তুচ্ছ কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। দিনভর খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে যে রোজার সৃষ্টি, এর আসল প্রাণশক্তি হলো আত্মার সংশোধন ও আচার-ব্যবহারে পবিত্র পরিবর্তন। যেমন রোজাদারের মিথ্যা কথার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা ছাড়লো না, আল্লাহ পাকের কাছে তার এসব পানাহার বর্জন করার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। (বুখারী) আরেক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রোজা ঢাল বা প্রতিরোধক। রোজাদার ব্যক্তি রোজা রেখে যেন অশ্লীলতা কিংবা অনাচার এবং মূর্খতায় লিপ্ত না হয়। কেউ তাকে গালি দিলেও সে যেন বলে দেয়, আমি একজন রোজাদার। (বুখারী ও মুসলিম)

চারদিকে নিজেদের পার্থিব কায়-কারবারে শুধু বাহ্যিক রূপ ও রং-ঢং লাবণ্যে আমরা যেমন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, নিজেদের ইবাদত বন্দেগীর বেলায়ও মূল মর্মার্থ কিংবা প্রাণশক্তির উৎস এড়িয়ে বহিরাবরণের রসম-রেওয়াজে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছি। রোজা তো আমরা অনেকেই রাখছি, দিনভর তপ্ত রোদেও না খেয়ে কষ্ট করছি, অফিস ফেরত ক্লান্ত কর্মজীবী অনেক মানুষ পথের তীব্র যানজটের কষ্ট সহ্য করে রোজা রেখে চলেছে। কিন্তু যাত্রাপথে কিংবা ঘরে-বাইরে কোথাও আচার-আচরণে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় মিথ্যাচার অথবা কাউকে ধোঁকা দেওয়া কিংবা কারোর জন্য সামান্য কষ্টের কারণ হওয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য যে সচেতনতা ও ধৈর্য এবং উদারতা প্রয়োজন, তা কয়জন লালন করছি? ভোগ নয়, ত্যাগের সাধনায় উজ্জীবিত এ মহিমান্বিত রমজানে যদি এ বিষয়গুলো থেকে আমরা উদাসীন হই- তবে এ উদাসীনতার ফাঁকে আমাদের এ দিনভর কষ্টকর রোজা ও সিয়ামের মূল বিষয়টিই নষ্ট হয়ে যাবে।

প্রিয় পাঠক, ঈমানের কালিমার পর নামাজ থেকে নিয়ে রোজাসহ ইসলামী শরীয়তের প্রতিটি হুকুমের অন্যতম লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আত্মশুদ্ধি এবং মানবচরিত্রের সংশোধন। মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচার-ব্যবহার এবং সবার জন্য মানবিক উদারতা ও সৌন্দর্যের মোড়কে মোড়ানো রোজার মূল্য এবং গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহ পাকের কাছে অনেক অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং মূল্যবান। যে আল্লাহকে ভয় করে সে আল্লাহ পাকের সৃষ্টজীবের প্রতিও সতর্ক থাকে, কারণ আল্লাহ পাকের ভয় তার হৃদয়ে অন্য সবার অধিকার সম্পর্কে যে সচেতনতা তৈরি করে, এটাই তো তাকওয়া। রোজার উদ্দেশ্য হিসেবে পবিত্র কুরআনে তো এমন তাকওয়ার কথাই বলা হয়েছে। যে রোজার সাধনায় তাকওয়ার অর্জন নেই, চরিত্রের অসঙ্গতিতে কোনো পরিবর্তন নেই, এমন প্রতিক্রিয়াবিহীন রোজারও কোনো মূল্য নেই।

আসুন, পার্থিব বিষয়ে আদি ও খাঁটির প্রতি আমাদের যে মোহ ও ভালোবাসা রয়েছে, নিজেদের অপার্থিব ও চিরমূল্যবান ইবাদতের বেলায়ও এর ব্যবহারে আমরা যত্নবান হই। শুধু ক্ষুধার্ত কিংবা পিপাসার্ত হয়ে মসজিদে ছুটে বেড়ানোর মধ্যে নয়, রোজার প্রকৃত আবহ পেতে হলে পরিবর্তনের সূচনা হতে হবে নিজের মনোজগত থেকে। এ পরিবর্তনের মধ্যেই রোজাদারের জন্য প্রকৃত সম্মান ও সাফল্যের নিশ্চয়তা লুকিয়ে রয়েছে।

শিক্ষার্থী, কাতার ইউনিভার্সিটি, দোহা

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024