হুমায়ূন আহমেদ আর কখনও আমাদের সামনে আসবেন না। হিমু কিংবা মিসির আলীর নতুন কোনো গল্প হাজির হবে না। হুমায়ূনের জন্য নতুন প্রজন্ম বই পড়তে শিখেছে।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নামটি কেন যেন তাকে বলতে ইচ্ছে হয় না। এতোটা প্রতাপশালী লেখককে বলতে হয় কিংবদন্তি। একটি অধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ হুমায়ূন আহমেদের দখলে চলে গেছে। ১৯ জুলাই তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন হয়েছে।
তার চলে যাওয়ায় সে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা খুব ভালোভাবে অনুভব করেন নতুন প্রজন্ম। কারণ, এ মানুষটির মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে অনেকের পরিচয় হয়েছে।চলে যাওয়ার একবছর পরও এ প্রজন্মের প্রতিটি মানুষ হুমায়ূন ছাড়া সাহিত্য ভাবতেই পারছেন না। নানানভাবে নানান গল্পে প্রকাশ করছেন হুমায়ূনকে ঘিরে তাদের অনুভূতি। তাদের কয়েকজনের মন্তব্য স্বপ্নযাত্রা পাতায় তুলে ধরা হলো।
একরামুল হক শামীম, সাংবাদিক ও ব্লগার হুমায়ূন আহমেদ আমার শৈশবের হিরো। শৈশবে স্বাভাবিকভাবেই ‘আউটবই’ পড়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের আপত্তি থাকে, বারণ থাকে। যাবতীয় আপত্তিকে পাশ কাটিয়ে আউটবই পড়া শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের মাধ্যমে। আত্বীয় স্বজনদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বই পেলে ঝটপট তা পড়ে নিতাম।
তার বইয়ের বড় গুনটি হলো, একবার শুরু করলে তা শেষ করে উঠতে হয়। বইয়ের বাক্যগুলো পড়লে মনে হয় এটি তো আমার নিজেরই কথা, আমিও হয়তো এমন করেই যাপিত জীবনের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতাম। বাঙালি মধ্যবিত্তের হাসি, কান্না, সংগ্রাম, অভিমান আর কে তুলে ধরতে পেরেছে হুমায়ূন আহমেদের মতো। হুমায়ূন আহমেদ আমার শৈশবের দিনগুলোকে অনেক বেশি আনন্দময় করে দিয়েছিলেন।
জ্যোৎস্না বিলাস, বৃষ্টি বিলাস হয়তো হুমায়ূন আহমেদের কাছেই পাওয়া। কতো কতো সময় যে ভাবতাম হিমু হবো! কতো কতোবার চেষ্টা করেছি হুমায়ূন আহমেদের মতো করে লিখতে। লেখক হতে চাওয়ার এতো যে আকাঙ্ক্ষা, তাও হুমায়ূন আহমেদকে দেখে দেখে। যতোগুলো বইমেলায় গিয়েছে অনেকগুলো করে হুমায়ূন আহমেদের বই কিনেছি। বাসায় ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। সেই যে শৈশবে শুরু হয়েছিল হুমায়ূন পঠন, আজও তা সমানভাবেই চলছে।
এখনও তার নতুন কোনও বই পেলেই সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। অনেকেই বলে থাকেন সময়ের সাথে সাথে তাদের হুমায়ূন মুগ্ধতা কমেছে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কমেনি। আগের মতোই মুগ্ধতা নিয়ে তার লেখা পড়ি, আর ভাবি কীভাবে এতো সুন্দর করে তিনি লিখেন, আমি কেন পারি না! টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখে হেসেছি, কেঁদেছি, চলচ্চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
হুমায়ূন আহমেদ পেরেছিলেন বাঙালির আবেগকে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরতে। মানুষ হুমায়ূন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, এখনও কেমন যেন বিশ্বাস হতে চায় না। বইমেলায় প্রিয় লেখকের নতুন কোনও বই প্রকাশিত হবে না, ভাবতেই বিষাদগ্রস্ত হয় মন। নিশ্চিতভাবে জানি, হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যের মূল্যায়ন হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া সম্ভব নয়।
রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান, বিজ্ঞাপন কর্মী তখন সে এক ভীষণ সময়! সদ্য ভুমিষ্ট পুত্র সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। স্ত্রী শোকে পাথর! কন্যারা কাঁদছে।আর লেখক লিখছেন মনযোগ দিয়ে। ঈদের নাটক। প্রযোজককে কথা দিয়েছেন। এই সেই লেখক যার হাতে ছিল আবেগের কম্পাস। তিনি তার লেখা দিয়ে সেই কম্পাসকে ঘুরিয়ে নিতেন ইচ্ছা মতো।
কখনো রাগের দিকে, কখনো দু:খ আবার কখনো আনন্দের দিকে।তিনি প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সেই লেখক যিনি তৈরি করেছিলেন ভিন্ন একটি পাঠক-পৃথিবী। যে পৃথিবীতে পাঠকরা কখনো হিমু, কখনো রূপা, কখনো মিসির আলী, কখনো মোনা আবার কখনো পাড়ার দস্যি বাকের ভাই।
মাঝ মাঝে মনে হয় পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের চাইতেও হুমায়ুন -পৃথিবীতে পাঠক সংখ্যা বেশি। কিভাবে? যখন মানুষ একই সাথে হিমু আর শুভ্রকে লালন করে, যখন মিসির আলী আর ছোট মামা বাস করে একই সাথে পাঠকের মনে, তখন হুমায়ূনের পৃথিবীতো বড় হবেই।কি অবাক বিস্ময়ে ভাবি হুমায়ূন পৃথিবীটা নিয়ে! কি নিশ্চুপ তার বিচরণ! অবাধে তিনি তার পরিবারকে তুলে ধরেছেন সব পাঠকের সামনে পটে আঁকা ছবির মতো। এক পট ভেঙেছে তো আরেক পট গড়েছেন।সবই স্পষ্ট পাঠকের কাছে। এমন ক’জন লেখক আছেন যার জীবনটা পানির মতো স্বচ্ছ ছিল পাঠকের কাছে! হতে পারে সেই পানির নানা রং, কিন্তু সেখানে ছিল না আড়াল।
তিনি পারতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষক হতে। হতে পারতেন গবেষণাবিদ।তিনি করেছেনও। তারপরও তিনি সবচেয়ে বেশি কাছে টেনেছিলেন তার পাঠকদের। সুসময়ে অসময়ে যারা তাকে পরখ করেছে ভালোবেসেছে – সেই অগণিত পাঠকদের কাছে হুমায়ুন বার বার ফিরে এসেছেন শেষ দিন গুলোতেই। লেখকের খেয়ালীপনায় তাই ক্রোধে হোক – ভালোবাসায় হোক আর শ্রদ্ধাতেই হোক কেঁদেছে এই পাঠক পৃথিবীর সকল সদস্য।কারণ তাঁরা জানেন, এই লেখকের কোন না কোন শব্দ কাউকে না কাউকে একবার হলেও আন্দোলিত করেছে।ভিজিয়েছে আবেগে।
শ্রদ্ধা বিনম্র প্রিয় লেখক। তার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা বেগম আয়েশা ফয়েজকে, যার গর্ভে এসেছে এমন সন্তানেরা যারা এদেশের মানুষকে উপহার দিয়েছেন কিছু ‘উদাহরণ’, যা পাঠকের সামনে এসেছে পাথেয় হিসেবে।
তাই আজ হুমায়ূন থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না, যতদিন একজনও পাঠক বেঁচে থাকবেন – তার বুকে বেঁচে থাকবে হুমায়ূন আর তার প্রিয় খেলনা গুলো- তার সৃষ্টি শব্দগুলো, তার কাছেই জমা থাকবে আমাদের আবেগের কম্পাস।
কাজী রত্না, মিডিয়া কর্মী পিপলী বেগম, নামটা কেমন অদ্ভুত । এটা মানুষের নাম ? নাকি অন্য কিছু ? ছেলেবেলার কোন এক বইমেলা, সালটা মনে নেই। খুব বিরক্ত করছিলাম আম্মুকে বই কিনে দেওয়ার জন্য। প্রথম বই নামটি পিপলী বেগম, আমার ছোট্ট মাথায় মনে হল এটি বোধহয় কোন একটি গরীব মেয়ের গল্প হবে হয়তো।
বইটি সহ আরও কয়েকটি বই কিনেছিলাম সেবার বইমেলায়, কমিকস.. কিন্তু পথে কোথাও বাকি বই গুলো হারিয়ে গিয়েছিল। সবে ধন নীলমনি পিপলী বেগম আমার হাতে করে বাসায় আসলো।বানান করে করে পড়ি, অনেকদিন লাগলো পড়তে, শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, বইটি পিপড়ার গল্প। গল্পের নায়িকা পিপলী বেগম। সেই বইটির লেখক হুমায়ূন আহমেদ। পরিচয়টা সেখান থেকে।
আজ রবিবার নাটকটি মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখতাম, তিতলী ভালো না কঙ্কা ভালো সে নিয়ে যুদ্ধের শেষ ছিল স্কুলে। বড় হয়েছি আর সাথে যোগ হয়েছে আরও অনেকগুলো বইয়ের নাম। কখনও হিমু, কখনও শুভ্র, আবার কখনও মিসির আলী…
ক্রমেই মনে হতে লাগলো হুমায়ূন আহমেদ হল মন খারাপের দাওয়া , মুড ভালো না, হুমায়ূন আহমেদ পড়া যায়, ভারী ভারী লেখকের লেখা পড়ার চাপে যখন ব্রেন হালকা করা প্রয়োজন, তখন প্রয়োজন হুমায়ূন আহমেদ।
তবে নন্দিত নরকে, জোছনা ও জননীর গল্প পড়ার পর মনে হল, নাহ্ এই ভদ্রলোক তো ভারী লেখাও লিখতে পারেন। আমার এই হালকা – ভারী লেখকের চিন্তার পাল্লার সাথেই বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া আর সেইভাবে দেখে যাওয়া আমার হুমায়ূন আহমেদ।
সৌজন্য: স্বপ্নযাত্রা।
Leave a Reply