স্বদেশ জুড়ে: একাত্তরে সব হারানো মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন রমা চৌধুরী। এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রীও।
শনিবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে দু’জনের মধ্যে কথোপকথন চলে। প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীর সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। ৭১’এ পাক হানাদারদের নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন। যুদ্ধকালীন বিভৎসতা নিয়ে দু’জনের দীর্ঘ সময় আলাপ হয়। এ সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় দু’জনে আবেগাফ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নায় ভেঙে পড়েন রমা চৌধুরী। রমা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৭১’র স্মৃতিচারণ করেন।
রমা চৌধুরী বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে আসতে পেরেছি।এজন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এ সময় প্রধানমন্ত্রীও বলেন, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমিও আনন্দিত ও গর্বিত। এরপর প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে রাখেন কিছুক্ষণ।
এরপর প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ১৯৭৫ সালে আমরা দুই বোন মা-বাবা, ভাই সব হারিয়েছি। সব হারানোর বেদনা আমি বুঝি। তিনি বলেন, কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার হারানোর বেদনাকে ভুলে থাকতে পারে। ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন মনে হয় সেই সব দিনের স্মৃতি তখন বড় কষ্ট হয়। এ রকম সব মানুষেরই হয়। ৭১-এ যারা স্বজন হারিয়েছে, যারা হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে সবারই বড় কষ্ট হয়। সেই কলঙ্ক মোচনের জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে।
রমা চৌধুরী বলেন, আমি জানি আপনি (প্রধানমন্ত্রী) মানুষের জন্য দেশের জন্য আপনার বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো করছেন। আপনি আমার বয়সে ছোট। ছোট বোন হিসেবে আমি আপনাকে আর্শিবাদ করি। আশা করি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো আপনার নেতৃত্বে সমাপ্ত হবে। দীর্ঘ আধা ঘণ্টার আলাপ শেষে প্রধানমন্ত্রীকে চট্রগ্রাম গেলে তার বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রমা চৌধুরী ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় থাকেন তিনি। রমা চৌধুরীর আজই ঢাকা ত্যাগ করে চট্রগ্রাম যাওয়ার কথা রয়েছে। রমা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার লেখা বই ‘একাত্তরের জননী’ উপহার দেন বলে জানান সঙ্গে থাকা বইটির প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন।
এর আগে শনিবার ভোরে ঢাকায় পৌঁছেন রমা চৌধুরী ও তার বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। সকাল ১১টার দিকে শাকিল নিজেই রমা চৌধুরী, আলাউদ্দিন খোকন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সীমান্ত তালুকদার ও চন্দন দাসকে নিয়ে গণভবনে পৌঁছান। বেলা ১২টা ২০ মিনিটে রমা চৌধুরীকে নিয়ে মাহবুবুল হক শাকিল গণভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।
উল্লেখ্য, রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তাঁর স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। এ সময় দুগ্ধপোষ্য সন্তান ছিল তাঁর কোলে। এর পরও তাঁকে নির্যাতন করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়ি। পুড়িয়ে দেয় তাঁর সব সম্পদ। নিজের নিদারুণ এই কষ্টের কথা তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে।
২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। যদিও তাঁর লেখ্যবৃত্তির পেশা একেবারেই স্বনির্বাচিত ও স্বতন্ত্র। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
Leave a Reply