বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্য বিচারে অক্ষম কতিপয় সাংবাদিকের গণিতবিদ্যার দীনতায় ক্ষুব্ধ নবীন প্রজন্মের রাজনীতিক-পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি নিজে থেকেই তাঁর সাড়ে চার বছরের বিশ্বভ্রমণের খতিয়ান প্রকাশ করেছেন। এ কাজটি আরও আগে করলে নিশ্চয়ই উৎসাহী সংবাদপত্রগুলোর পক্ষে একেবারে নির্ভুল সংবাদ প্রকাশ করা সম্ভব হতো। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দৃষ্টান্ত তুলে ধরাটা বোধ হয় মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সে দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা ও সফরের বিবরণ নথিবদ্ধ থাকে এবং তা নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থাও আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়েবসাইটে ট্রাভেলস উইথ দ্য সেক্রেটারি নামে একটি পাতা আছে, যাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিটি সফরের হিসাব প্রকাশ করা হয়। তিনি শুধু কটি দেশ সফর করেছেন তা নয়, এমনকি কত মাইল সফর করেছেন, প্রতিটি সফরের শেষে তা-ও হালনাগাদ করা হয়। ২৩ জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এ পর্যন্ত ২৭টি দেশ সফর করেছেন, যাতে তিনি অতিক্রম করেছেন এক লাখ ৪৬ হাজার ১৬৪ মাইল। জন কেরির পূর্বসূরি হিলারি ক্লিনটন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বাধিকসংখ্যক দেশ সফরকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি মোট ৪০১ দিন বিদেশ সফর করেছেন, যাতে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে মোট নয় লাখ ৫৬ হাজার ৭৩৩ মাইল। সাংবাদিকদের হিসাবে এই দূরত্ব অতিক্রম করার অর্থ হচ্ছে, মোট ৩৮ বার বিশ্ব পরিক্রমণ করার পরও তাঁর আরও প্রায় ছয় হাজার মাইলের বেশি উদ্বৃত্ত থাকবে। বাংলাদেশের ‘সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ (নিজের দাবি অনুযায়ী) সংবাদ সম্মেলনে যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে অবশ্য তিনি বলেননি যে তাঁর উড়াল দেওয়া পথের পরিমাণ কত বা ঠিক কতগুলো দেশ সফর করেছেন। তিনি বলেছেন যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি মোট ১১৪টি দেশ সফর করেছেন এবং দেশের বাইরে ছিলেন মোট ৫১৭ দিন (ডেইলি স্টার, ২২ জুলাই, ২০১৩)। তাঁর নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি হিলারির চেয়ে ১১৬ দিন বেশি বিদেশে ছিলেন। সুতরাং গড়পড়তা হিসাব করলে হিলারি যতটা পথ উড়েছেন, তার চেয়ে কিছুটা বেশিই ওড়ার কথা তাঁর। তবে, ধরে নেওয়া যায় যে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরগুলোর বেশ কিছু সফর ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারের মতো কাছের দেশগুলোতে। তবে, দিল্লি ঘুরে আসতেও অন্তত দেড় হাজার মাইল উড়াল দিতে হয়, আর ইউরোপ বা আমেরিকায় হলে একেকবার সফরে (যাওয়া এবং আসায়) কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ হাজার মাইল উড়তে হবে। সুতরাং হিলারির অতিক্রম করা দূরত্বের চেয়ে বেশি পথ পাড়ি দেওয়া যদি তাঁর পক্ষে সম্ভব না-ও হয়ে থাকে, তাহলে কিছুটা কাটছাঁট করে হিসাব করলেও তা হিলারির সমান হলে বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না। সাংবাদিকদের অঙ্কে কাঁচা হওয়ার দুর্নাম মাথায় নিয়েই তাই নিশ্চিন্তে বলা যায় যে দীপু মনি যদি হিলারির অর্ধেকটা রাস্তাও পার হয়ে থাকেন, তাহলে প্রায় ২০ বার তিনি বিশ্ব পরিক্রমণ করেছেন। অতএব, ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতা ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে’ অন্তত একজন বাংলাদেশির ক্ষেত্রে সার্থক হয়েছে। তা-ও একবার নয়, অন্তত ২০ বার। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার হিসাব অনুযায়ী পুরো পৃথিবী একবার ঘুরে আসতে গড়ে ২৫ হাজার মাইল অতিক্রম করতে হয়। আর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে চাঁদের দূরত্ব হচ্ছে তার ১০ গুণ অর্থাৎ গড়ে প্রায় আড়াই লাখ মাইল। সুতরাং তাঁর নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর থেকে চাঁদে ঘুরে আসাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। যদি তাঁর উড্ডয়ন মাইল হিলারির সমান হয়ে থাকে, তাহলে তিনি অন্তত দুবার চাঁদ ছুঁয়ে আসতে পারতেন। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, হিলারি তাঁর চার বছরের মেয়াদে এক বছর ৩৬ দিন বিদেশে ছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থানের সময়টি হবে ১ দশমিক ৪ বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। অর্থাৎ, গড়ে তিনি প্রতি তিন দিনের এক দিন ছিলেন দেশের বাইরে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেশের জন্য তাঁর এই যে ত্যাগ, এ জন্য আসলে তাঁর ক্লেশনিবারণ ( হার্ডশিপ অ্যালাউন্স) ভাতা পাওয়া উচিত। এ ধরনের ভাতা জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তো বটেই, এমনকি ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সেই সব কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন, যাঁদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কষ্টকর কোনো জায়গায় (যেমন যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে) দায়িত্ব পালন করতে হয়। সংখ্যার বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরবৃত্তান্তের তুলনা হলেও তার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো তুলনা চলে কি না, তা পাঠকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের রেকর্ড এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলে বিশ্বে তারা দুটি বড় আকারের যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এরপর ছিল মধ্যপ্রাচ্য-সংকট এবং তারপর ঘটেছে যুগান্তকারী আরব বসন্ত। বাংলাদেশের ৪২ বছরে তাঁর পূর্বসূরিদের আর কেউ এর সিকি ভাগও বিদেশ ভ্রমণ করেছেন কি না, সন্দেহ। অবশ্য এই সন্দেহ দূর করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে তাঁর নিজেরটাসহ পূর্বসূরিদের সবার ভ্রমণবৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে তাঁর মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। একই সঙ্গে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিথি হয়ে যাঁরা (গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ) বিভিন্ন সময়ে বিদেশ সফর করেছেন, তাঁদের তালিকাও প্রকাশ করা যেতে পারে। তাতে করে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের তালিকায় কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় কি না, সেটাও জানা যাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সফরগুলোর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের পেশাদার কূটনীতিকদের যোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। তিনি তাঁর সাফল্যগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিয়ে মামলার কথা বলেছেন। আদালতে মন্ত্রীর উপস্থিতির কারণে রায়ে কোনো তারতম্য হতে পারে, এমন যুক্তি তিনি না দিলেও পারতেন। সেদিন আদালতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল, কোনো মন্ত্রী নন। তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত হওয়াকেও তাঁর সাফল্য হিসেবে দাবি করেছেন। তার মানে কি এই যে ওই সব কমিটিতে নির্বাচিত হওয়ার জন্য কূটনীতিকদের পেশাদারি নৈপুণ্য যতটা প্রয়োজন, সেটার অভাব পূরণের জন্যই তাঁকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়েছে? তাহলে তো বরং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের পুনর্গঠন প্রয়োজন এবং কিছু কূটনীতিককে বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণে পাঠানো উচিত। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য বা পারিবারিক প্রয়োজনে সচরাচর বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, তাঁরা জানেন যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিমান কোম্পানি প্রতিযোগিতার কারণে যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে এয়ার মাইলস দিয়ে থাকেন এবং গড়পড়তায় প্রতি চার মাইল ওড়ার জন্য এক মাইল পাওয়া যায়। অবশ্য বিজনেস ক্লাস বা প্রথম শ্রেণীতে (মন্ত্রী হিসেবে যে শ্রেণীতে তাঁর ভ্রমণ প্রাপ্য) এই এয়ার মাইলস পাওয়ার হারটা অনেক বেশি। অর্থাৎ, একজন যদি চারবার টিকিট কেটে একই কোম্পানির বিমানে ঢাকা-লন্ডন যাতায়াত করেন, তাহলে পঞ্চমবার তিনি বিনা মূল্যে ওই একই জায়গায় বা সমান দূরত্বে অন্য কোনো জায়গায় ভ্রমণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ওই এয়ার মাইলস ব্যবহার করে তিনি তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভ্রমণসঙ্গী করতে পারেন। ওই সব এয়ার মাইলস বিলাসসামগ্রী কেনা অথবা বিলাসবহুল হোটেলে থাকার জন্যও ব্যয় করা যায়। ধারণা করা যায়, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে পরিমাণ এয়ার মাইলস জমেছে, তাতে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও সবার বিনা পয়সায় বিশ্ব পরিক্রমণ সম্ভব। এত সব কথার অবতারণার কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দের গণতন্ত্রের মডেল ওয়েস্টমিনস্টারের সংস্কৃতি। মাত্র পাঁচ বছর আগে এই এয়ার মাইলস পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহার করে বিপদে পড়েছিলেন হাউস অব কমন্সের তৎকালীন স্পিকার মাইকেল মার্টিন। স্পিকার মার্টিন তাঁর পরিবারের সাতজন সদস্যকে গ্লাসগো থেকে লন্ডনে উড়িয়ে এনেছিলেন ওই এয়ার মাইলস ব্যবহার করে, যেগুলো তাঁর হিসাবে জমা হয়েছিল স্পিকার হিসেবে বিমানে ওই পথে তাঁর নিয়মিত চলাচলের কারণে। তথ্যটি ফাঁস হওয়ার পর এমপিরা মি. মার্টিনের সংসদীয় অভিশংসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন (ডেইলি মেইল, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০০৮)। তারও ১০ বছর আগে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল যে সরকারি সফরে অর্জিত মন্ত্রীদের এয়ার মাইলস সম্পর্কে সরকারের নীতি কী? প্রধানমন্ত্রীর জবাব ছিল: মন্ত্রীদের আচরণবিধিতে স্পষ্ট করে বলা আছে যে সরকারি খরচে ভ্রমণের জন্য অর্জিত এয়ার মাইলস শুধু পরবর্তী সরকারি সফরেই ব্যবহার করা যাবে অথবা তা ছেড়ে দিতে হবে। তবে, মন্ত্রীরা যদি তা কোনো কল্যাণমূলক কাজে অর্থাৎ চ্যারিটিকে দিতে চান, সংশ্লিষ্ট বিমান কোম্পানির পছন্দের কোনো দাতব্য সংস্থায় তা দান করা যাবে। (সূত্র: হ্যানসার্ড—পার্লামেন্টারি কার্যবিবরণী) বাংলাদেশের মন্ত্রীদের আচরণবিধিতে এমন কোনো বিধান আছে বলে শুনিনি। থাকলে ভালো, না হলে আশা করি তা যুক্ত হবে।
Leave a Reply