তামীম রায়হান: শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান। এ মাসের প্রতিটি ইবাদত যেন অবহেলায় বিফলে ব্যর্থ না হয় সেজন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে রমজানের এ মধ্যবর্তী সময়েও।
সারা বছরের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে আল্লাহ পাকের কাছ থেকে মার্জনা ও ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার এমন বিরল সুযোগ আগামীবার জুটবে কি না, নিশ্চয়তা নেই। মাহে রমজানের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের আগ থেকেই তাঁর দোয়ায় আল্লাহ পাকের কাছে ফরিয়াদ জানাতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।
মুআল্লা ইবনুল ফযল (র.) বলেছেন, আমাদের পূর্বসুরী বুযুর্গরা রমজানের আগে বছরের ছয় মাস শুধু এ দোয়ায় করতেন যেন আল্লাহ পাক তাদের রমজান মাস পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন। আর রমজানের পর বাকি ছয় মাস তারা দোয়া করতেন, আল্লাহ পাক যেন অতীত হওয়া রমজান মাসে কৃত সব নেকআমলগুলো কবুল করে নেন। তবে এ রমজানকে সত্যিই সাফল্যময় অর্থে কাজে লাগাতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে-তওবা। তওবা শব্দের অর্থ-ফিরে আসা। সারা বছর এবং জীবনভর স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সময়ে-অসময়ে যে গুনাহগুলো আমরা করেছি, সেসব থেকে ফিরে এসে একনিষ্ঠ অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ পাকের কাছে তওবা করা।
এ জীবনে চলার পথে আমাদের সামনে দু’টি পথ খোলা। একটি গিয়ে পৌঁছেছে সোজা জান্নাতের দোরগোড়ায় আরেকটি পৌঁছেছে জাহান্নামের অগ্নিচূড়ায়। প্রথমটি আল্লাহর পথ আর দ্বিতীয়টি শয়তানের। এ জীবনযাত্রায় প্রায়ই আমরা আমাদের আসল পথ ভুলে গিয়ে পা বাড়াই শয়তানের মনভোলানো ভ্রান্তির অলি-গলিতে। নিজেদের ভেতরে প্রবৃত্তির তাড়নায় আমরা কত অনৈতিক ও অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ি নিজেদের অজান্তে। তারপর একসময় হয়তো সজাগ হয়ে যাই, ভেতরে বোধ জাগে হায়! এ কি করলাম আমি?
এ অনুশোচনা থেকে মুক্তি এবং যে অসৎ কিংবা অসুন্দর কাজ আমরা অহরহ করে ফেলি সেসব থেকে ফিরে আসার জন্য আল্লাহ পাক আমাদের জন্য ব্যবস্থা রেখেছেন তওবার। তওবার মাধ্যমে আমরা ফিরে আসতে পারি নিজেদের আপন বৃত্তে, পরম দয়াময়ের আশ্রয়ে। তওবা আমাদের সব পঙ্কিলতাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়, মানুষ তখন সত্যিকার অর্থেই হয়ে ওঠে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। আল্লাহ পাক এমন সুন্দর ও সহজ ব্যবস্থা দেওয়ার পরও আমরা তার মতো পরম করুণাময়ের দিকে ফিরে যেতে মনোযোগী হই না। সৃষ্টির সর্বসম্মানিত মহামানব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব ধরণের গুনাহ থেকে চিরমুক্ত থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন আল্লাহর কাছে একশ বার ইস্তেগফার ও তওবা করতেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক আমাদের ডেকে ডেকে বলেছেন, ওহে মুমিন বান্দারা, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো সবাই, এতে তোমরা সফল হবে। (সূরা নূর-৩১) মনে রাখা প্রয়োজন, চারটি শর্ত ছাড়া কেবল মুখে ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পড়লেই তওবা হবে না। বরং তওবা কবুল হওয়ার জন্য প্রথমেই ওই গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে যেটি থেকে আপনি তওবা করতে চাচ্ছেন। তারপর এতোদিন ধরে এ গুনাহে লিপ্ত থাকায় আল্লাহর কাছে সত্যিকার ভাবে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এমন গুনাহ আর হবে না, এ মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। মানুষের কোনো অধিকার সম্পর্কিত গুনাহ করে থাকলে তা আদায় করে দিতে হবে কিংবা মাফ চেয়ে নিতে হবে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে।
উপরোক্ত এ বিষয়গুলোর সমন্বয়ে যে অনুশোচনার জন্ম হয়, সেটিই প্রকৃত তওবা। আর এ সুযোগ আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত। মৃত্যুদশায় তওবা সর্বাবস্থায় কবুল হয় না। আল্লাহ পাক বলেন, নিশ্চয়ই তওবা তাদের জন্য যারা না জেনেই গুনাহ করেছিল এবং তারপর খুব দ্রুত তারা তওবার দিকে ধাবিত হয়, এদের জন্যই আল্লাহ পাক তওবা কবুল করেন, আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়। তাদের জন্য কোনো তওবা নেই যারা জীবনভর গুনাহে লিপ্ত থেকে মৃত্যু মুহূর্তে বলে, আমি এখন তওবা করছি, কিংবা যারা কাফের অবস্থায় মারা যাচ্ছে, এমন লোকদের জন্য আমি কঠিন শাস্তি রেখেছি। (সূরা নিসা-১৭-১৮) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীসেও এ আয়াতের প্রতিধ্বনি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
তাই, তওবার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে রমজানের বিকল্প নেই। রমজানের সূচনা থেকে রহমত, মাগফিরাত এবং নাজাতের যে দ্বার আল্লাহ পাক খোলা রেখেছেন-তা দিয়ে প্রবেশের এখনই উপযুক্ত সময়। যারা ভাবছেন, তওবা করে কি লাভ? এ গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়া আমার জন্য সম্ভব নয়-তারা সত্যিই শয়তানের ফাঁদে বসবাস করছেন। কারণ, তওবার পর আবার গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়লে আবারও তওবার দরজা খোলা। কেউ যদি জীবনে হাজার বার তওবা করে এবং প্রতিবারই নিজের প্রবৃত্তি কিংবা শয়তানের কাছে পরাজিত হয়ে সেই গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়-তবে সে আরও হাজার বার তওবার সুযোগ পাবে।
দয়াময় আল্লাহ পাক তার মৃত্যু পর্যন্ত এ সুযোগ দিয়ে রেখেছেন-কাজেই লজ্জা কিংবা সংকোচের কোনো সুযোগ নেই। বরং এমন সন্দেহ সৃষ্টি করে শয়তান আমাদের তওবার সুযোগ থেকে বিরত রাখছে প্রতিনিয়ত। আমরা কি পারি না, শয়তানকে ব্যর্থ করে দিয়ে তওবার এ অপার্থিব অফার গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে নিতে?
Leave a Reply