বহুমুখী এক ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। অধ্যাপনা, সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও লেখালেখির বাইরে তিনি একজন সফল সংগঠক। তার স্বপ্ন ও চিন্তার ফসল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। যা আজ দেশব্যাপী বইপড়া আন্দোলনের সূতিকাগার। লাখো ছাত্র-ছাত্রীর মেধা ও মননের বিকাশে নিরন্তন কাজ করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। গড়ে তুলছে আগামীর নেতৃত্বকে। সফল সংগঠক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ২৫শে জুলাই পা রেখেছেন পঁচাত্তরে। সবছাপিয়ে লেখালেখির নানা ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
সমস্যাসঙ্কুল দেশ নিয়ে সচেতনভাবে তিনিও চিন্তা করেন। গভীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে তা লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার গতি-প্রকৃতি নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর লেখা ‘গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’ বইটি ২০০৯ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর পঁচাত্তরতম জন্মদিনের চলমান সময়ে মানবজমিন অনলাইন পাঠকদের উদ্দেশে বইটির খণ্ড খণ্ড অংশ প্রকাশিত হলো- ১৮ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় দেশে বল্গাহীন দুর্নীতি হয়েছিল। তবু কেউ যদি জিগ্যেস করে দুর্নীতির দিক থেকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচার ভালো ছিল না আজকের এই গণতন্ত্র ভালো, তবে আমি এরশাদের পক্ষেই মত দেব। সামরিক স্বৈরাচারের অন্তত একটা দুর্বল দিক থাকে যা জাতির স্বার্থের অনুকূল। তা হল এর জনবিচ্ছিন্নতা। এর ক্ষমতার উৎস একটিমাত্র জায়গা-ক্যান্টনমেন্ট। সারা জাতি মুখিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে।
এই বিশাল জনবিরোধিতার চাপ তাকে সবসময় সন্ত্রস্ত রাখে। তাই প্রতিটি দুর্নীতির আগে এই বিপদের কথা তাকে মনে রাখতে হয়। এরশাদ এটা ঠিকমতো করেননি বলে আজঅব্দি তাকে এর চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী জনবিচ্ছিন্ন নন। তার পেছনে রয়েছে দেশের চল্লিশ বা পঞ্চাশ ভাগ মানুষের সমর্থন। এই বিশাল জনসমর্থন আর নিজ দলের সাষ্টাঙ্গ আনুগত্য নিয়ে যখন তিনি দুর্নীতি করেন, তখন তাতে বাধা দেবার শক্তি তার হাতে জিম্মি ঐ অসহায় জাতিটির থাকে না। প্রশাসনকে পুরোপুরি দলীয়করণ করে এই দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব। শক্তিশালী সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি, সুষ্ঠু ক্রয়নীতি, মজবুত দুর্নীতিদমন কমিশন, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যায়পালদের তদারকি-এ ধরনের যেসব নিñিদ্র ব্যবস্থা গড়ে তুলে দুর্নীতির রাস টানা সম্ভবআমাদের লুণ্ঠনলোলুপ গণতন্ত্র এ ধরনের পদক্ষেপগুলো নিজেদের স্বার্থেই নিতে রাজি নয়। কিছুদিন আগে এক টিভি সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নকারী আমাকে জিগ্যেস করেছিল, আমাদের দেশে এত দুর্নীতি কেন? আমি জবাবে বলেছিলাম, ধরার লোক নেই বলে।
আজ আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র চলছে সেখানে সরকারি দলের যে কোন লোক জাতির যাবতীয় সম্পত্তি লুঠ করে সবার সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেও তাকে বাধা দেবার কেউ নেই। আজ তার পেছনে এরশাদের মতো মাত্র এক লাখ সৈনিকের ছোট্ট একটি বাহিনী নেই। রয়েছে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার সমর্থন। তার দুর্নীতিতে বাধা দিতে গেলে ঐ দলের বিশাল সমর্থকদের পায়ের তলে পিষে মরতে হবে। ফলে দুর্নীতি আজ এদেশে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে শিরোপা পেয়েছে এবং দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারা জাতীয় সম্পদ এমনভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে যার তুলনা গত বিশ বছরের পৃথিবীতে আর কোন দেশে নেই। সামরিক আমলেও দেশে দুর্নীতি ছিল, কিন্তু তা ছিল একেবারেই ওপরের মহলের ব্যাপার।
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্তর-পারস্পর্যের কারণে আজ তা জাতির উঁচু থেকে নিচু পর্যায়ের প্রতিটি রন্ধ্রে চুইয়ে গিয়ে জাতির রক্ত শোষণ করছে। আমলাতন্ত্রকে দ্বিখন্ডিতকরণের অন্যতম কারণও দুর্নীতি। রাজনীতিবিদদের পক্ষে দুর্নীতি করা আমলাতন্ত্রের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং পদোন্নতির বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে সেইসব আমলাকে নিজ দলে ভিড়িয়ে ফেলতে হয় যারা ঐ দুর্নীতিতে তাদের বিশ্বাসযোগ্য দোসর হতে পারবে। যারা বিপক্ষ দলের বা দলের হয়েও দুর্নীতিতে জড়াতে আগ্রহী নয় তাদের চোখ রাঙানি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘যদি সহযোগিতা করতে পার তো পদে থাক। না হলে নেমে যাও। সহযোগিতা করলে বুঝব তুমি আমাদের লোক। না হলে তো বোঝাই যাচ্ছে তুমি কাদের’।
এভাবে আমলাতন্ত্রকে দু’টুকরো করার মাধ্যমে নিজ দলের আমলাদের সহযোগিতা নিয়ে দুর্নীতির ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও দলীয়করণের একটা লক্ষ্য। ৭০ অনুচ্ছেদের ফলশ্রুতিতে দেশের গণতন্ত্র যদি এভাবে স্বৈরাচারে রূপ না নিত, অর্থাৎ দেশে যদি চলনসই গণতন্ত্র থাকত, পরিবেশ থাকত বন্ধুত্বপূর্ণ ও হার্দ্য, নির্বাচনে বিজয় মানে সর্বক্ষমতার অধিকারী হওয়া বোঝাত না কিংবা পরাজিত হওয়া মানেও বোঝাত না রাজনীতি থেকে মুছে যাওয়া, যদি বিজয় মানে বোঝাতে রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে অধিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া, পরাজয় মানেও রাষ্ট্র পরিচালনায় যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করা, তাহলে হয়ত পরিবেশ এমন নিষ্ঠুর আর অনমনীয় হয়ে উঠত না।
Leave a Reply