গ্যালারী থেকে ডেস্ক: দীর্ঘ ইতিহাস। ২২ গজের জমিনে তৈরি হয়েছে কত না আখ্যান। জয়-পরাজয়-বেদনার নানা কাব্য। অনেকেই বলেন, ক্রিকেট আসলে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। জীবন যেমন উত্থান-পতনের নানা ছবি দেখে ক্রিকেটও তাই। প্রতিটি দিনই নতুন। শুরু করতে হয় শূন্য হাতে।
এ যেন রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী। সোনার ধান নিতে রাজি থাকলেও মানুষটাকে নিতে রাজি নয়। রোববার রাতের মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখেছেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের বারবার আক্রমণে ক্লান্ত। কিছুটা আবেগিও বটে। ভারতীয় সাংবাদিকরা বলছেন, এমন এমএস ধোনিকে তারা কোনদিন দেখেননি। অনেক ইতিহাসের মধ্যে মিরপুরে এটাও কি একটা ইতিহাস নয়?
এক গ্রেট খেলোয়াড়ের অসহায় আত্মসমর্পণের ইতিহাস। আনন্দবাজারের ভাষায়, জীবনে প্রথম অভিমানী হয়ে ধোনি বললেন, আমাকে সরিয়ে দিন। একেবারেই বিপরীত চিত্র মাশরাফি বিন মর্তুজার ব্রিফিংয়ে। জীবনের উত্থান-পতন তার থেকে বেশি ক্রিকেট দুনিয়ায় আর কেউই দেখেনি- এটা বাজি ধরেই বলতে পারি। এবারও ধোনির সঙ্গে তার যখন প্রথম দেখা হয়, জানতে চান পায়ের অবস্থা কি?
ক্রিকেটে সবচেয়ে বিখ্যাত পা-যুগল। ছয়টি অপারেশন হওয়া পা ক্রিকেটে কি আর আছে? প্রথম ম্যাচ থেকেই মাশরাফি বিন মর্তুজা ছিলেন তারকা। গতির তোড়ে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা প্রথম বাংলাদেশী বোলারও তিনি।
এরপর ইনজুরি বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জীবনে। আর তিনি এগিয়ে গেছেন পরম বিক্রমে। অধিনায়ক হওয়ার পর আমূল বদলে ফেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকেই। তাকে অধিনায়ক বানানোর সিদ্ধান্তের জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও। তার ছায়ায় পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটিই পরিণত হয় লড়াকু বাঘে। লড়াই ছাড়া যারা এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে রাজি নয়। রেকর্ড বলছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক তিনি।
বিশ্বকাপ থেকে শুরু হয়েছিল তার স্বপ্নযাত্রার। এরপর পাকিস্তানকে বলেকয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। এবার সিরিজ জয় পূর্ণ করলেন ভারতের বিরুদ্ধে। দেশের মাটিতে টানা দশম জয়। তারপরও সন্তুষ্ট নন, মাশরাফি বিন মর্তুজা। বললেন, আরও উন্নতির সুযোগ আছে।
এবার ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ শুরুর আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তেজনা। মূলে ছিল বিশ্বকাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনাল। অবিচারের শিকার হয়ে যে ম্যাচে হার মেনে নিতে হয় বাংলাদেশের। যে ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্রিকেট মোড়লদের কাছ থেকে অবমাননার শিকার হন খোদ আইসিসিরই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আ.হ.ম মুস্তফা কামাল।
পরে অবশ্য তিনি আইসিসি সভাপতির পদই ছেড়ে দেন। এতোসব বিতর্কের কারণে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজটি শেষ পর্যন্ত হবে কি-না এ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল। সাকিব আল হাসান অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আলাদা এক চরিত্র। মনের মধ্যে যা আছে তাই বলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশই ফেভারিট। না ভারতের বিরুদ্ধে সাকিব এমন ঘোষণা দেননি।
উল্টো মেনে নেন, ভারতই ফেভারিট। তবে বল মাঠে গড়াতে গড়াতেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। একমাত্র টেস্টটি ড্র হয়েছে। যদিও ওই ড্রয়ে মূল কৃতিত্ব বৃষ্টির। পুরোটা ম্যাচ জুড়েই ড্রাইভিং সিটে ছিল ভারত। বাংলাদেশের একমাত্র পাওয়া ছিল জুবায়েরের মায়াবী বোলিং।
তবে ১৮ই জুন ওয়ানডে সিরিজ শুরু হতে হতেই মাঠে দেখা মেলে সত্যিকার বাঘের। এই যুগের গিলক্রিস্ট-হেইডেন আমাদের তামিম-সৌম্য উড়িয়ে দিতে শুরু করেন ভারতীয় বোলারদের। ফাস্ট বোলারদের ডাউন দ্যা উইকেট গিয়ে সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলা শুধুতো স্কোর বোর্ডই সচল করে না। বরং বোলারদের মনোবল ভেঙে চুরমার করে দেয়। এ যেন ক্রিকেটের মোহাম্মদ আলী। যে প্রবল বিক্রমে ঘোষণা দেয়, আমিই সেরা। ব্যাটিংটা অবশ্য পুরো ইনিংসে একরকম হয়নি।
তবে শেষ পর্যন্ত তিনশ’ রান ঠিকই পেরোয় বাংলাদেশ। যদিও সবচেয়ে বেশি বার তিনশ’ রান চেজ করে জেতা দলটির নাম ভারত হওয়ায় এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরের রূপকথার নায়ক একজনই। মুস্তাফিজুর রহমান। সাতক্ষীরার আনকোরা লিকলিকে ছেলেটি ভারতের বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপে ধস নামান। ক্রিকেট ইতিহাস আগমনী বার্তা পায় এক গ্রেট ফাস্ট বোলারের আবির্ভাবের। পরাজয় মেনে নেয় ভারত। কিন্তু মুস্তাফিজ ম্যাজিকের শেষ হয় না। দ্বিতীয় ম্যাচে ছেলেটি আরও ভয়ঙ্কর। ৫ উইকেটের পিঠে নেন ছয় উইকেট। এই জয়রথে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত করে ফেলে বাংলাদেশ।
আইসিসি র্যাঙ্কিং বলছে, ওয়ানডে টিমের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে। কিন্তু চলতি বছরের পারফরমেন্স বলছে বাংলাদেশের স্থান আরও অনেক উপরে। ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পারফরমেন্সের ভিত্তিতে সেরা দল অস্ট্রেলিয়া। এসময়ে অস্ট্রেলিয়া ১৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে। জয় পেয়েছে ১১টিতে। তাদের জয়-পরাজয়ের অনুপাত এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বে সবার শীর্ষে।
এরপরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ বছর ১১টি ম্যাচ খেলেছে। এরমধ্যে জয় পেয়েছে ৮টি ম্যাচে। জয়-পরাজয়ের অনুপাত ২.৬৬৬। জয়-পরাজয়ের অনুপাত ছাড়াও এ বছর অনুষ্ঠিত ওয়ানডে ম্যাচে জয়ের সংখ্যার দিক থেকেও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো ক্রিকেট পরাশক্তির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
সেই কিলাত ক্লাব মাঠে দেড় যুগ আগে শুরু হয়েছিল স্বপ্ন যাত্রার। একটি ক্রিকেটপাগল জাতির জন্ম। এরপরের চলার পথ মসৃণ ছিল না। বেশির ভাগ সময়ই পুড়তে হয়েছে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায়। মাঝে মাঝে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর জয়। তবে জয়কে অভ্যাসে পরিণত করা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে চলতি বছরই প্রথম। এ যেন এক বিস্ময়কর উত্থানের গল্প। এ গল্প শুধু ব্যক্তিবিশেষের নয়, একটি জাতির। বিভক্তির জন্য সারা দুনিয়ায় যাদের পরিচিতি। একমাত্র ক্রিকেটেই তাদের ঐক্য। দল নেই, রাজনীতি নেই, ধর্ম নেই। সবাই এক কাতারাবদ্ধ।