কাফি কামাল: ভবিষ্যতে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে বিএনপি কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে সে মনোভাব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাইছে কূটনীতিক মহল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘নতুন ধারার সরকার’ পরিচালনার বিষয়টি এখন তাদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে সোমবার রাতে বিরোধী নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা।
রাজনৈতিক মহল এ বৈঠকটিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বৈঠক শেষে ড্যান মজিনা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক মহলে। বিষয়টি স্বীকার করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরাও। বিএনপি সূত্র জানায়, চারটি বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার কাছে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বিষয়গুলোতে বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব জানতে চেয়েছেন।
বিষয়গুলো হচ্ছে- দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, উগ্র মৌলবাদ ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার যে অভিযোগ রয়েছে ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারলে বিএনপি তা বিবেচনায় নেবে কিনা? দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের ব্যাপারে বিএনপি’র অবস্থান কেমন হবে? বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে কিনা। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সার্বিকভাবে বিএনপির সম্পর্ক কেমন হবে। বিশেষ করে বিএনপির ‘নতুন ধারার সরকার’ কেমন হতে পারে?
জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের নেতৃবৃন্দ দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের ব্যাপারে নেতিবাচক ও কঠোর মনোভাবের কথা তুলে ধরেছেন। প্রচলিত প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক উপলব্ধির কথা তুলে ধরে বলেছেন, ভবিষ্যতে জনগণ সুযোগ দিলে নতুন ধারার সরকার পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি’র। সেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, দলীয় একদেশদর্শিতা নয়; ঐক্যই হবে সরকার পরিচালনার মূলনীতি। ঐক্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি। ঐতিহাসিক বিরোধমূলক মনোভাবকে এড়িয়ে ঐতিহাসিক সম্পর্কের মনোভাবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায় বিএনপি।
বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতাকে কোনভাবেই পাত্তা দিতে চান না বেগম জিয়া। পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে চান। বিশেষ করে সন্ত্রাস মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চান। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ভবিষ্যতে কি কি বিষয়কে প্রাধান্য দেবে, সে বিষয়গুলো নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ হোক- এটা প্রত্যাশা করে আমেরিকা। কিন্তু দুই প্রধান দলের অনড় মনোভাবের কারণে সেটা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তাদের। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকেও মজিনা সে উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন।
যে কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর চায় আমেরিকা। অন্য কোন শক্তির উত্থান চায় না। এ কারণে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়াটা জরুরি বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে। তাই তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান দুই দলকে সমঝোতায় আসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, শুধু বিএনপি নয়, দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই মনে করে নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। বিএনপি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনেও অংশ নেবে না। জনগণের সহায়তা ও সমর্থনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করবে।
তিনি বিশ্বাস করেন, দেশের মানুষ যেভাবে সরকারের উপর থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নিচ্ছে তাতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় সম্ভব। তিনি এ-ও বলেছেন, সরকার বারবার বিরোধী দলকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির ব্যাপারে আমেরিকার নেতিবাচক মনোভাবের জবাবে বিরোধী নেতা পরিষ্কার বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিগুলো বিচার করলে দেখা যাবে কিভাবে নৈরাজ্য এড়াতে চাইছে বিএনপি। তবে হরতাল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি। কেবল পরিস্থিতি বাধ্য করলেই সে পথে হাঁটবে বিএনপি। প্রয়োজনে হরতাল দেয়া হবে।
বিএনপি সূত্র জানায়, বিরোধী দল বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন যে, জনগণের ভোটে যেখানে ৫টি সিটি নির্বাচনে বিজয় পেয়েছে বিএনপি। সকল জরিপসহ নানা ঘটনা পরম্পরায় প্রকাশিত জনগণের মনোভাবে বোঝা যাচ্ছে আবারও সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট- সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে আপত্তি কোথায়? কেনই বা বিএনপি ভয় পাচ্ছে?
সূত্র জানায়, জবাবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দেশবাসীর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের নানা কারণ তুলে ধরেছেন খালেদা জিয়া। জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল মাত্র কয়েকটি শহরে সীমাবদ্ধ। দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমের নজর ছিল এ নির্বাচনে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে একই দিনে পুরো দেশে নির্বাচন হবে। সেখানে পুরো দেশ এরকম নজরদারির মধ্যে থাকবে না। আর এ সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাবে সরকার। তিনি বলেছেন, গাজীপুর বা বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। সেখানে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রভাব সৃষ্টির নানা চেষ্টা চালিয়েছে।
কিন্তু জনগণের কারণে ফল পাল্টানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটের সুরক্ষা সম্ভব হবে না। এছাড়া, কেবল বিএনপি নয়, দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল মনে করে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের কাছে জোর দিয়েই বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি ও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রথমদিকে বর্তমান সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল আমেরিকার। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পরিক্রমায় ধীরে ধীরে সে অবস্থানে চিড় ধরে।
তবে বিএনপির প্রতি যে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন রয়েছে এবং দিন দিন বেড়েছে কূটনীতিকদের আস্থায় আসেনি প্রথম দিকে। সমপ্রতি ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের পর টনক নড়ে তাদের। তারা এখন বিশ্বাস করে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার গঠন করবে। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের স্বতন্ত্র কোন পলিসি নেই। বিষয়টি তারা স্বীকার না করলেও নানা কর্মকাণ্ডে তাই প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ অঞ্চলে তারা কৌশলগত কারণে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেই অন্য দেশগুলোর ব্যাপারে পলিসি প্রণয়ন করেন।
ফলে ভারত প্রসঙ্গে বিএনপির মনোভাব বুঝতে চান তারা। নেতারা জানান, বিএনপির নতুন ধারার পলিসিতে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দুইপক্ষের লাভের ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।
কৃতজ্ঞতা: মানবজমিন।
Leave a Reply