গোলাম মোর্তোজা: কেউ একজন বিদেশে চলে গেছেন, হয়তো সেদেশের নাগরিক হয়েছেন। হয়তো দেশে থাকা অসুস্থ বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করছেন না। ধরে নিলাম ‘কী করা উচিত’ আপনি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আপনার ‘উচিত’ কথা শোনেননি। ধরে নিলাম, আপনার এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্যি। তো? সব প্রবাসী দেশ ছেড়ে গেছেন ‘বিদেশিদের জুতোপলিশ’ করতে?
একজন লেখক- কবি কমপক্ষে এক কোটি প্রবাসীদের নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। তার প্রেক্ষিতে চলছে আলোচনা- সমালোচনা এবং বিষোদগার। এত আলোচিত প্রসঙ্গ থাকা সত্ত্বেও কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি বিষয়টি নিয়ে।
১. শুরুতেই বলে রাখি এটা বুঝতে কারও সমস্যা হচ্ছে না যে ‘জুতোপালিশ’ বলতে আক্ষরিক অর্থে ‘জুতোপালিশ’ বোঝানো হয়নি। ‘জুতোপালিশ’ বলতে এমন সব কাজকে বোঝানো হয়েছে, যে কাজগুলো আমাদের মানসিকতায় ‘ছোট কাজ বা নিম্নশ্রেণির কাজ’ মনে করা হয়। যেমন ট্যাক্সি চালানো, সব রকম শ্রমিকের কাজ, হোটেল- রেস্টুরেন্টের বয় বা পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার কাজ প্রভৃতি। বেঁচে থাকার জন্যে, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যে, নিজের এবং পরিবারের টিকে থাকার জন্যে, ছোট ভাইদের পড়ানোর জন্যে, ছোট বোনের একটু ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যে, বাবা- মাকে একটু শান্তিতে রাখার জন্যে, সন্তানের নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যে, কেউ যদি নিজের শ্রম দিয়ে যে কোনও রকমের কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন, এমন কী ‘জুতোপালিশ’ও করেন, তাকে সুস্থ- স্বাভাবিক বুদ্ধির অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন অথবা নিরক্ষর কোনও মানুষই অসম্মান করে কথা বলতে পারেন না। ‘বিদেশীদের জুতোপালিশকারী’ বলে আসলে আপনি গালি দিচ্ছেন। এর উত্তরে প্রবাসী যারা আপনাকে গালি দিচ্ছেন, তার উত্তরে আপনি আবারও গালি দিচ্ছেন আর বলছেন ‘আমাকে গালি দিচ্ছে’। গালিটা যে আপনি শুরু করেছেন, তা উপলদ্ধি করছেন না বা করতে চাইছেন না। গালাগালির এই সংস্কৃতি অবশ্যই পরিতাজ্য হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে বেশি নিন্দা আপনার প্রতি, কারণ গালিটা আপনি শুরু করেছেন। আপনাকে যারা গালি দিচ্ছেন নিন্দা জানাই তাদেরকেও। অনুরোধ করি কেউ কাউকে গালি দেবেন না, গালির উত্তরও গালি ছাড়া দেওয়া যায়। আপনারা যে দেশে থাকেন, সেদেশে এমন নজীর আছে। দয়া করে তা আয়ত্ব করুন। এতে আপনাদের মহত্বের প্রকাশ ঘটবে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর কোনও দেশেরই সব মানুষ তার বাবা-মা বা পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেন না। দেশে থেকেও করেন না, দেশের বাইরে থেকেও করেন না। যে সমাজ বা দেশে প্রয়োজন হয় না, সেই সমাজ বা দেশের কথা বলছি না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যারা প্রবাসে থাকেন, তাদের প্রায় সবাই বাবা-মা বা পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেন। নিজে কত কষ্ট করে উপার্জন করেন তা বাবা-মাকে বুঝতে দেন না, কষ্ট পাবেন বলে। দায়িত্ব পালন করেন না, এমন প্রবাসী আছেন, তবে তা খুবই নগন্য- উল্লেখ করার মতো নয়। দেশে থেকেও, সামর্থ্য আছে এমন কেউ কেউ আছেন যারা বাবা-মা বা পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেন না। এর সঙ্গে প্রবাসে থাকা বা অন্য দেশের নাগরিক হওয়া বা দেশে থাকার কোনও সম্পর্ক নেই।
২. কবির সুমনের একটা গানের লাইন ‘আমাদের এ শহরে গ্রাম থেকে উঠে আসা প্রাক্তন চাষা- ভূষা…’। সবচেয়ে বড় আমলা বা ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই খুপরি ঘরে থেকে কূপির আলোয় পড়াশোনা করে, লুঙ্গি কাছা দিয়ে কয়েক কিলোমিটার কাদা রাস্তায় হেঁটে স্কুলে গিয়েছেন, ক্ষুধার্ত পেটে বাড়ি ফিরেছেন, বাবা ‘চাষা’র ঘরে সব সময় যে খাবার থাকত তাও নয়। এই তো আমাদের বাংলাদেশ। আপনি বলতেই পারেন, আমরা এমন ছিলাম না। আপনি ছিলেন না, আপনার বাবা ছিলেন বা আপনার দাদা ছিলেন বা দাদার বাবা ছিলেন, তা কিন্তু খুব বেশিদিন আগের কথা নয়!
লিখে বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকজন মানুষ সফল হয়েছেন, স্বচ্ছল জীবনযাপন করার সামর্থ্য অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ইমদাদুল হক মিলন। জীবিকার সন্ধানে প্রথম জীবনে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আর দশজন প্রবাসী যা করেন তিনিও তাই করেছেন। আবার দেশে ফিরে এসেছেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল জনপ্রিয় লেখক সফল সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনের অতীত নিয়ে কোনও গ্লানি নেই। অকপটে গর্বের সঙ্গে স্বীকার করেন, লেখকের সংবেদনশীল হৃদয় দিয়ে প্রবাসীদের দেখেন শ্রদ্ধা- ভালোবাসার চোখে। যিনি মানুষকে অসম্মান করেন তিনি বড় নন, বড় ইমদাদুল হক মিলন। এটা বোধের ব্যাপার, সব মানুষের তা থাকে না।
৩. মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে যারা থাকেন, তাদের থেকে যাওয়ার সুযোগ নেই। যা আয় করেন সবই দেশে পাঠান। উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যারা যান, তাদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে থেকে যান। নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সাধারণত প্রায় কেউ-ই আর দেশে ফিরে আসতে চান না। জাপানে নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ খুব সীমিত। পার্মানেন্ট রেসিডেনশিপের সুযোগ নিয়ে অনেক প্রবাসী অবস্থান করছেন।
যারা নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তারা বাংলাদেশের মায়া ত্যাগ করেছেন? সমীকরণ এত সহজ! বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার অধিকার থাকবে না তাদের? কথা বললে তা ‘মায়াকান্না’ হয়ে যাবে?
ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যারা অন্য দেশের নাগরিক হয়েছেন তাদের সবাই ( দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) বাংলাদেশেরও নাগরিক। অন্য দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশের প্রতি তার প্রেম অন্য যে কারও চেয়ে কম। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। দেশের বাইরে প্রবাসীরা যে যেখানে আছেন, তাদের সবারই উচিত সেই দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করা। সেই দেশের নাগরিক হলেই তার নিজের ও সন্তানের জীবনযাপন সহজ হয়। পরিবারের অন্যদের প্রতি বা দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করার সুযোগ প্রসারিত হয়। সুযোগ তৈরি হয় আত্মীয়- স্বজনদের প্রবাসে নিয়ে যাওয়ার।
নিউইয়র্কের এক যুবকের কথা বলি। তার আমেরিকান পাসপোর্টধারী আত্মীয় ছাত্র হিসেবে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে রেস্টুরেন্টেও কাজ করেছেন। দাঁত ব্যাথা নিয়ে কাজ করেছেন, অর্থের অভাবে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি বড় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশ থেকে অনেক আত্মীয়-পরিজনদের আমেরিকায় নিয়ে গেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানে অনেককে চাকরি দিয়েছেন। দেশে বিনিয়োগ করেছেন। এই আমেরিকান নাগরিক তো বাংলাদেশেরও নাগরিক। তার অধিকার নেই দেশ নিয়ে কথা বলার? একজন নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন প্রবাসী আছেন হাজার হাজার।
বিক্রমপুরের যুবকেরা জাপানে গিয়েছিলেন পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে। প্রায় সবাই অসম্ভব কষ্ট করেছেন প্রথম জীবনে। তাদের অনেকেরই দেশের অবস্থা শুধু ভালো নয়, বেশ ভালো। তাদের কেউ কেউ দেশে থাকলে কবি- আবৃত্তিকার হিসেবে পরিচিতি পেতেন। জাপানে না গেলেও তাদের অনেকে স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন। তাদের জাপানে যাওয়ার ফলাফলটা কী হয়েছে?
একজন ইউজড কার ব্যবসায়ী তার পরিবারের ৪৫ জনকে জাপানে নিয়ে গেছেন। তার প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন চাকরি করেন, যার মধ্যে পাঁচ ছয়জন জাপানিজ। একজন নয়, জাপানে এমন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক। জাপানের ইউজড কার ব্যবসার প্রায় পুরোটা এক সময় নিয়ন্ত্রণ করতেন পাকিস্তানিরা। এখন জাপানিজ ইউজড কারের বিশাল বাণিজ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের অনেকে পৃথিবীর ৪০ টিরও বেশি দেশে গাড়ি রফতানি করেন। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তাদের অফিস আছে। সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে গেছেন। দেশে নানা সেক্টরে তারা বিনিয়োগ করেছেন, করতে চাইছেন। সেই সব যুবকরা জাপানে গিয়েছিলেন বলে এসব সম্ভব হয়েছে। একজন কবি বা লেখকের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, একজন প্রবাসীর গুরুত্ব বা সম্মান কারও চেয়ে কম নয়, অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। তা তিনি মধ্যপ্রাচ্যের কনস্ট্রাকশন কর্মী বা সিলিকন ভ্যালির আইটি বিশেষজ্ঞ, নিউইয়র্ক- টোকিও -সিডনি বা ইউরোপের কর্মী-ব্যবসায়ী যিনিই হোন না কেন।
৪. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে বাংলাদেশ সচল আছে। অংকের হিসেবে এক্ষেত্রে দেশের ব্যবসায়ীদের আয়ের পরিমাণ বেশি। তাদের অবদানকে ছোট করে দেখছি না। ব্যবসায়ীরা যেমন আয় করেন, তেমন রফতানি প্রণোদনাসহ অনেক সুযোগ- সুবিধা নেন। সুযোগ- সুবিধাহীনভাবে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান প্রবাসীরা। সেই বিবেচনায় একথা স্বীকার করতে হবে, অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তারা একথা যতটা বলেন, আরও বেশি বলার অধিকার তাদের আছে। তথাকথিত এলিট আমলা- রাজনীতিবিদ- ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেন। মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে কাজ করা কর্মীরা দেশে অর্থ পাঠান, তথাকথিত দুর্নীতিবাজ এলিটরা সেই অর্থের একটা অংশ পাচার করে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বসতি স্থাপন করেন। কেউ কানাডার বেগম পাড়া, নিউইয়র্ক – ওয়াশিংটন – ফ্লোরিডা বা লন্ডনে বাড়ি কেনেন দেশ থেকে দুর্নীতি করে নিয়ে যাওয়া অর্থে।
প্রবাসীদের কাজকে যারা অসম্মান করেন, তারা নিজেদের এই এলিট শ্রেণির মানুষ ভাবতে পছন্দ করেন।
৫. একথা ঠিক যে বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে বেশি ভাবেন। এই ভাবনাটা আর একটু কম থাকলে কোনও ক্ষতি ছিল না। বিশেষ করে প্রবাসীরা রাজনৈতিক ভাবনায় না জড়ালে তাদের জীবন আরও আনন্দময় হতো বলে আমার বিশ্বাস। তাই বলে প্রবাসীরা দেশ নিয়ে ভাবতে পারবেন না, রাজনৈতিক অন্যায় – অনিয়ম- দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না, এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না। যেহেতু তার অবদান আছে সেহেতু তিনি অন্য দেশের নাগরিক হলেও দেশ নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন। যেহেতু প্রবাসীরা বাংলাদেশের মানুষ, জন্মগতভাবে তারা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন কথা বলেন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, কল্পনায় তার সেই দেশ ইউরোপ- উত্তর আমেরিকা- অস্ট্রেলিয়া বা জাপান বা পাশের মালয়েশিয়া- থাইল্যান্ডের মতো। এসব দেশের মতো হওয়ার প্রত্যাশা করার মধ্যে কোনও অপরাধ নেই। পাঠানো অর্থ পাচার -চুরি হওয়া নিয়ে কথা বলা তার অধিকার, কোনও ভাবেই ‘মায়াকান্না’ নয়।
যে সমাজে বা দেশে ত্রুটি- বিচ্যুতি, অন্যায়- অনিয়ম, বৈসম্য, আইনের শাসনহীনতা বেশি থাকে, সে দেশের মানুষকে দেশ নিয়ে বেশি ভাবতে হয়, কথা বলতে হয়। সে কথা দেশে যারা থাকেন তারা বলেন, দেশের বাইরে যারা থাকেন তারাও বলেন। এই বলাটা দরকারও।
প্রবাসীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, প্রবাসীদের অসম্মান করা আপনি নিজেকে কবি- এলিট যাই ভাবেন, শ্রদ্ধা করতে পারি না। সুস্থভাবে বাঁচার জন্যে কবিতা খুব জরুরি, অর্থ তার চেয়েও জরুরি। প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো কমিয়ে দিলে বা কমে গেলে, পরিস্থিতি কেমন হতে পারে- তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। সুতরাং তাদেরকে অসম্মান করার আগে, তথাকথিত এলিটদের একবার আয়নার সামনে দাঁড়ানো দরকার।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক