রাজনীতি ডেস্ক: বিদায় নিলেন এক পরিচ্ছন্ন আর ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ। নিভে গেলো আলো। আওয়ামী লীগে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।
গতরাতে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশের রাজনীতির এক অসাধারণ চরিত্র। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা আশরাফের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো দুর্নীতি বা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠেনি। রাজনীতির ক্রাইসিস মুহূর্তে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন সৈয়দ আশরাফ।
অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁকে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়। দেশে না থেকেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসন থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গতকাল সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা শপথ নিলেও আশরাফের পক্ষ থেকে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। সে আবেদনে সাড়াও মিলে। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। রাতে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী সৈয়দা শিলা ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩শে অক্টোবর লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর থেকেই অন্তরালে চলে যান সৈয়দ আশরাফ। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এটা হয়তো নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনীতিতে আসা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা ছিল না। খুব ছোটবেলায় এক আদর্শবাদী পিতাকে দেখে তিনি বড় হয়েছেন। শিখেছেনও হাতে-কলমে। সময় ১৯৫২।
‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। বছরখানেক আগে সরকারি চাকরি ছেড়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম যোগ দিয়েছেন অধ্যাপনা পেশায়। শুরু করেছেন ওকালতিও। সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একই বছর তার ঘর আলোকিত হয় এক পুত্র সন্তানের আগমনে। নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ছোট বেলাতেই সৈয়দ আশরাফ দেখেছেন রাজনীতিবিদ পিতার ব্যস্ততা। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন পুরোদমে সক্রিয়। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতিরও। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরিণত হন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাণপুরুষে।
ছোট বেলা থেকেই সৈয়দ আশরাফ দেখেছেন রাজনীতির জন্য কিভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পিতাকে দেখে তিনি বুঝেছিলেন সততা আর বিশ্বাস কখনও পরাজিত হয় না। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাজনীতিতে অভিষেক হয় সৈয়দ আশরাফের। ছাত্রলীগেই তার রাজনীতির হাতেখড়ি। স্বাধীনতার পর তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। এরআগে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ইতিহাস সরল পথে চলেনি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোদ্ধারা। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা বসে ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আঘাত হানে তারা। সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নির্মম এ হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতা হাত মেলান খুনিদের সঙ্গে। বারবার চাপ দেয়া হয় জাতীয় চার নেতাকে। কিন্তু তারা আপোষ করেননি। পরিণতিতে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তাদের। আর কারাগারেই ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। সে সময়কার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে সবাই মোশ্তাক হয় নাই। সবাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। অনেকেই নিজের জীবন দিয়েও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাস রক্ষা করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে পিতাকে হারানোর পর বিলাতে চলে যান সৈয়দ আশরাফ। সেখানে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে এসে সক্রিয় হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। অংশ নেন ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে তিনি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে রাজনৈতিক জীবনে সৈয়দ আশরাফ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জরুরি জমানায়। শেখ হাসিনার জন্য তখন বৈরী সময়।
এক পর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তারও হন। নেতাদের একটি অংশ রাজনীতি থেকে তাকে মাইনাসে তৎপর। পর্দার অন্তরালে সক্রিয় কুশীলবরা। এ পর্যায়ে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলে দলীয় সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন আশরাফ। আবদুল জলিল গ্রেপ্তার হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। লড়াই চালাতে থাকেন সভানেত্রীর পক্ষে। এক পর্যায়ে পিছু হটে কুশীলবরা। মুক্তি পান শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়েও সক্রিয় ভূমিকা ছিল সৈয়দ আশরাফের। দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর। ২০০৯ সালে কাউন্সিলে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর বিডিআর বিদ্রোহের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় সরকারকে। সৈয়দ আশরাফের তখনকার ভূমিকাও প্রশংসনীয়। এরপর প্রতিটি ক্রাইসিস মুহূর্তেই তিনি রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর পদ হারালেও সৈয়দ আশরাফ সবসময়ই আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তদবিরবাজদের থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন তিনি। সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশের রাজনীতির এক বিরল চরিত্র। তার ক্লিন ইমেজে কখনও তিনি কালিমা পড়তে দেননি। মন্ত্রিত্ব হারানোর পর নানা গুঞ্জনের মধ্যে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।’ এটাই রাজনীতিবিদ সৈয়দ আশরাফের আসল পরিচয়।