সৈকত হাবিব: যে মুহূর্তে কবি দিলওয়ারের প্রয়াণ সংবাদ পেলাম (১০ অক্টোবর), একটা গভীর শূন্যতায় আচ্ছন্ন হলাম। এমনটা হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের চিরবিদায়ের পর। মনে হয়েছিল এই ঢাকা শহরে আর কোনো কবি জীবিত নেই, যিনি তাঁর মতো এত সহৃদয়-অভিভাবত্ব করতে পারেন। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, একজন মহৎ কবিই বোধহয় সবচে ভালোভাবে তা জানেন। আর শামসুর রাহমান এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
একই কথা বলা জরুরি আমৃত্যু সিলেটবাসী কবি দিলওয়ারের ক্ষেত্রেও। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিলেটের সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। আমরা রাজধানীবাসীরা যেমন শামসুর রাহমানকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি, সিলেটের আমাদের আপনজনদের সেই একই অবস্থাই বিরাজ করছে। কেননা, কবি দিলওয়ারের ক্ষেত্রে ‘গণমানুষের কবি’ কেবল কারো দেওয়া শংসা-সম্মান নয়, অতিবাস্তব একটি বিশেষণ। কী রচনায়, জীবনযাপনে, চিন্তা ও দর্শনে তিনি ছিলেন গণমানুষের।
আজ এই আত্মরতির দিনে যখন কবিরা কেবল আত্মকুণ্ডয়নে ব্যস্ত, যখন জনতার আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে তাদের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, জনগণের ভাষা যখন কবিরা বুঝতে অনেকটাই অক্ষম, তাদের ভাষাও যখন গণবিচ্ছিন্ন, তখন এই কবি ছিলেন বোধ-চেতনা-বিশ্বাসে পুরোপুরি আত্মপরায়ণের বিপরীত জনগণপরায়ণ।
একই সঙ্গে স্থানিক আবার বৈশ্বিক তাঁর যে মনো ও বাস্তব জগৎ, এর প্রেরণা হয়তো তিনি পেয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। কারণ রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব ভ্রমিয়াও শেষ পর্যন্ত শেকড়সংলগ্ন ছিলেন। কবি দিলওয়ারও তাই। তিনি তাঁর কৃতী তারুণ্য রাজধানী শুরু করেও ফিরে গেছেন তাঁর শেকড় সিলেটে। কেবল তাই নয়, তাঁর বৈশ্বিক সত্তাকেও তিনি বিকশিত করেছেন নিজের শেকড়ে বসেই (এজন্যই হয়তো নিজের সম্পর্কে বলতে পারেন, তিনি গৃহের নয়, গ্রহের নাগরিক)। এবং তিনি তাঁর কেন্দ্র করেছেন সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী-নিপীড়িত মানুষকে। আর এ যে কোনো মানবতাবাদ-বিলাস নয়, তা অনুভব করা যায় তাঁর পারিবারিক সামন্ত-পদবি ‘খান’ নিজের নাম থেকে কেটে দেয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন কেবল একটিমাত্র শব্দেই– দিলওয়ার। কোনো দিলওয়ার খান বা চৌধুরী নয়। এ থেকেই তাঁর গণসংলগ্নতা টের পাওয়া যায়।
অন্যদিকে আমৃত্যু সিলেট শহরে বাস করলেও তিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক। আর এজন্যই তিনি বলতে পারেন ‘পৃথিবী স্বদেশ যার/আমি তার সঙ্গী চিরদিন।’ চিররুগ্ন আর মৃত্যু-সমাচ্ছন্ন জীবনেও (কেননা নিজের জীবদ্দশায় তিনি দেখেছেন প্রাণপ্রিয় প্রেমিকা-স্ত্রী আর কবিপুত্রের অকালপ্রয়াণ) এই কবি ছিলেন আকণ্ঠ জীবন ও স্বাধীনতাপিপাসু। তাই তিনি বলেন, ‘যতদিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো,/আকাশ মাটির কণ্ঠে যেন শুনি তুমি বেঁচে আছো।’
ষাট বছরের বেশিকাল তিনি সৃজনী জীবনযাপন করেছেন, তাঁর কবি-পরিচয় সবকিছু ছাপিয়ে উঠলেও ছড়াসাহিত্য, সঙ্গীত, নাটকেও তাঁর আছে অতুলনীয় অবদান। লিখেছেন গল্প ও নানাজাতীয় গদ্য। আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, সিলেট বেতার যাত্রা শুরু করেছে তাঁর গান দিয়েই। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতারে গীত হয়েছে তাঁর বহু গান।
অন্যদিকে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ– তিনি যাপন করেছেন এক ধরনের যোদ্ধার জীবন। জাতীয় ও স্থানীয় অনেক আন্দোলনে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা। জীবনের পুরোটা সময় তিনি ছিলেন বিপ্লবী, স্বাধীনতাকামী ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে। তাঁর রচনায়ও এর অজস্র চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। শাদাসিধে স্নিগ্ধ-নরম হৃদয়ের এই মানুষটির অন্তর যে কী পরিমাণ দ্রোহী ও দৃঢ় ছিল, তা হয়তো কেবল তাঁর রচনার ভিতর দিয়েই টের পাওয়া যায়।
মানবজীবনের জন্য ছিয়াত্তর বছর হয়তো মোটামুটি দীর্ঘ-আয়ু, কিন্তু যখন তা কোনো কবির বয়স তখন যেন এ বড় কম। বিশেষত দিলওয়ারের মতো একজন অভিভাবকতুল্য গণলগ্ন কবির ক্ষেত্রে। কেননা, তিনি তাঁর রচনারাশির বাইরে শারীরিকভাবেও অনেকের কাছেই ছিলেন আত্মিক আশ্রয়।
কিন্তু কবি তো অবিনশ্বর। কেননা শরীর ছাড়িয়ে তিনি অমরলোকে নীত হলেও মাটিপৃথিবীর জন্য তাঁর মতো গভীর করে কে রেখে যাতে পারে এত প্রগাঢ় হৃদয়চিহ্ন? আর আমাদের হৃদয় স্নাত করার জন্য অজস্র মুক্তো কি ছড়িয়ে রেখে যাননি কবি দিলওয়ার?
কৃতজ্ঞতা: কবি এ কে শেরাম ও রুদ্র মিজান