শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে প্রায় এক দশক আগে শুরু হয় সাংগঠনিক উদ্যোগ। নিজেদের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে সামনে আনতে চায় রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন।
২৬ জন পুরুষকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আরাকান আর্মির। প্রাথমিক সদস্য তালিকায় ছিল ভাগ্যের অন্বেষণে উত্তরাঞ্চলের খনিতে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা। প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয় চীন সীমান্তবর্তী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির দখলে থাকা একটি অঞ্চলকে। ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে সংগঠনটি। বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা।
কারও ধারণা, এই মুহূর্তে তাদের সদস্য সংখ্যা ৩ হাজার। কেউ আবার মনে করে, ৭ হাজার সেনা রয়েছে তাদের। তবে সবাই মানেন, সামরিক শক্তি নয়, তাদের প্রকৃত অস্ত্র আরাকানের জনসাধারণের অকুন্ঠ সমর্থন। সেকারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংগঠনের সঙ্গে শক্তির লড়াইয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বেগ পেতে হবে।
উপকূলীয় রাখাইন প্রদেশ অতীতে স্বাধীন আরাকান রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৮ শতকে বার্মিজদের আগ্রাসনে অঞ্চলটির সার্বভৌমত্ব হারায়। উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে লড়ছে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি। উত্তরাঞ্চলীয় জোটে তাদের পাশাপাশি আরাকান আর্মিও রয়েছে। এছাড়া পশ্চিঞ্চলীয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও অবস্থান নিয়েছে আরাকান আর্মি। স্বাধীনতা দিবসে হামলার মধ্য দিয়ে রাখাইনে নিজের সক্রিয়তা জানান দিয়েছে তারা।
তেলসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাখাইন। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ -অঞ্চল হওয়ায় চীনেরও নজর রয়েছে এই প্রদেশে। তারপরও রাখাইন দেশটির অন্যতম দরিদ্র প্রদেশ। বিশ্ব ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ১৭ শতাংশ বাড়িতে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে, মিয়ানমারের অন্য যে কোনও প্রদেশের সাপেক্ষে যা সামান্য।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩ লাখ বাড়িতে টয়লেট নেই। এমন বাস্তবতায় কয়েক বছর ধরে ক্রমশ বাড়তে থাকা বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষকেই প্রচারণার উপজীব্য করেছে তারা। মিয়ানমার সরকারের অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক অবিচারের শিকার হওয়া রাখাইন আর এর ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে তারা পেয়েছে এক উর্বর ভূমি হিসেবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর করায়ত্ত রাখাইনে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা তাদের রাজনৈতিক পুঁজি। বঞ্চনার কথা তুলে আনায় সংগঠনটির সঙ্গে শরিকানা বোধ করে সাধারণ আরাকানিরা। মিয়ানমার ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির নির্বাহী পরিচালক ড. মিন জাও ও মনে করেন, ‘এই সমর্থনের কারণে আরাকান আর্মিকে রুখতে সেনাবাহিনীকে বেগ পেতে হবে।
আরাকানিদের বেশিরভাগই থেরবাদী বৌদ্ধ। এটাই মিয়ানমারের মূল ধর্ম। উপকূলীয় রাখাইন প্রদেশ অতীতে স্বাধীন আরাকান রাজ্য ছিলো। ১৮ শতকে বার্মিজদের আগ্রাসনে অঞ্চলটির সার্বভৌমত্ব হারায়।
গত বছর জানুোরিতে রাজ্যের সার্বভৌমত্ব হারানোর সেই বার্ষিকী পালন করে স্থানীয়রা। সেই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনের পরই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টির প্রধানসহ দুইজন অধিকারকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এখনও বিচারকার্য চলছে।
অনেক নৃগোষ্ঠী রাখাইন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনে এএনপির প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও ২০১৬ সালে সু চি নেতৃত্বধীন এনএলডি সরকার তাদের নিজস্ব মুখ্যমন্ত্রীকে সেখানে নিয়োগ দেয়।
রাখাইনের উত্ত ও মধ্যাঞ্চলেই শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে আরাকান আর্মির। এছাড়া বুথিয়াডং, রাথেডং, পোনাহগুন ও কুইকতাওয়েও নিয়ন্তণ তাদের। এছাড়া শিন প্রদেশের পালেতায়াতে শক্ত অবস্থান রয়েছে গোষ্ঠীটির।
ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামনে শক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে গোষ্ঠীটি। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে নিজেদের অভয়রাজ্য গড়ে তুলেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কয়েকবার বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে আরাকান আর্মির।
গোষ্ঠীটির দাবি, বিগত কয়েকমাসে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অন্তত ২৪টি হামলা চালিয়েছে তারা। তারা দাবি করে, রাখাইনে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে চালানো সামরিক আগ্রাসনের জবাব দিচ্ছেন তারা। ইরাবতিকে দেওয়া সাক্ষাতাকারে আরাকান আর্মির প্রধান ম্রাত নাইং বলেন, ‘রাখাইনের অবশ্যই নিজেদের বাহিনী থাকা উচিত। এমন সশস্ত্র বাহিনী থাকলেই রাখাইনের জাতিগোষ্ঠী টিকে থাকবে।’
৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসে মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের ফাঁড়িতে হামলা চালায় আরাকান আর্মির সদস্যরা। হামলায় ১৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত ও অপর ৯জন আহত হয়। ৫ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং মিয়াওয়াডি ডেইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্বে সংঘটিত যেকোনও হামলার চেয়ে এই হামলার ব্যাপকতা ও হামলাকারীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিলো।
হামলার পর সেখানে সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে কত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। স্থল, আকাশ ও নদীপথে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ২২ ও ৯৯ নং ক্র্যাক লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন থেকেও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সামরিক হেলিকপ্টারও ব্যবহার করেছে মিয়ানমার। ১৩ জানুয়ারি তাতমাদাওয়ের এক ইউনিটের সঙ্গে ৫০ আরাকান আর্মির চার ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।
গত ৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জাও তায় এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, আরাকান আর্মি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং তাদের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে। এবং বাংলাদেশে দুই গোষ্ঠীর বৈঠকও হয়েছে। তারা এই গোষ্ঠীকে দমন করতে বদ্ধ পরিকর।
মিয়ানমার ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির নির্বাহী পরিচালক ড. মিন জাও ও বলেন, মনে হচ্ছে ওই অঞ্চলে আরাকান আর্মির সবগুলো ঘাঁটি সরিয়ে ফেলবে সেনাবাহিনী, তারপর বিভিন্ন দিক থেকে হামলা চালাবে। আরাকান আর্মিকে হয়তো ঘাঁটি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
বেসামরিকদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে হবে। সেখানে তাদের অনেক বড় সমর্থনও রয়েছে। তাই যদি সেনাবাহিনী অভিযান চালায়, অন্তত তিন মাস সেখানে সহিংসতা চলবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাচিন বিদ্রোহীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া আরাকান আর্মিরা ২০১৭ সালের সংকটের জন্য দায়ী করা দুর্বল আরসার চেয়ে অনেক বড় হুমকি।
জেন’স আইএইচএস মারকিতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস বলেন, আরাকান আর্মির সেনারা উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং তাদের কাছে অনেক আধুনিক অস্ত্রও রয়েছে। সাম্প্রতিক সহিংসতাকে চলমান সংকটের ‘চরম মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি ২০১৫ সাল থেকে আরাকান আর্মি কিভাবে ছোট একটি গোষ্ঠী থেকে ধাপে ধাপে রাখাইনে রাজনৈতিক ও সামরিক বিস্তার ঘটিয়েছে। এখন সেটা অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে তারা। সামরিক প্লাটুন এমনকি কখনও কোম্পানির মতো শক্তিশালী হয়ে প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় প্রায় সবগুলো শহরেই প্রভাব বিস্তার করে আছে গোষ্ঠীটি এবং এটা একদমই অভিনব ঘটনা।
২০২০ সালের মধ্যে রাখাইনে রাষ্ট্রবিরোধী অভ্যুত্থান সফল করতে সেখানে প্রচারণাও শুরু করেছে আরাকান আর্মি। অনলাইনে প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছে।
সাবলীলভাবে তৈরি ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, তরুণ বিদ্রোহীরা রোডমার্চ করছে, আধুনিক অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ করছে। প্রায়ই দলটির নেতা তোয়ান ম্রাত নাইংকে গুরুত্ব দিয়ে ও নায়োকচিতভাবে তুলে ধরা হয়। তখন তার পরনে থাকে সামরিক পোশাক আর চোখে থাকে মোটা চশমা।
রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি আরাকান আর্মিকে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন; মিয়ানমার সেনাবাহিনী এমন দাবি করলেও এর সত্যতা সংশয়ের মুখে পড়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ওই সংগঠন হামলা চালায়। একদিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট দফতর থেকে আরাকান আর্মিকে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে এই নির্দেশনা সু চির কিনা, তা জানতে চেয়েও বেসামরিক প্রশাসনের কাছে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। একে গোপনীয় বিষয় উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। মিয়ানমার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিদ্ধান্তটি আদতে সেনাবাহিনীর নিজের।
১৮ জানুয়ারি (শুক্রবার) নেপিদোতে এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল তুন তুন নি দাবি করেন, ৭ জানুয়ারি বৈঠকে আরাকান আর্মিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বলে আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন সু চি।
তার দাবি ছিল, আরসার(ভিন্ন ধর্মাবলম্বী) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও আরাকান আর্মির(বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্ন এড়াতেই রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এমন নির্দেশ দিয়েছেন। সু চির নামে সেনাবাহিনী যে বক্তব্য হাজির করেছে, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি প্রেসিডেন্ট দফতর।
১৯ জানুয়ারি (শনিবার) সাংবাদিকদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট দফতরের মহাপরিচালক উ জাও তায় জানান, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের জমা দেওয়ার জন্য একটি নথি তৈরি করা হয়েছে।
ওই নথিকে ‘বিশেষায়িত তথ্য’ (প্রিভিলেজড ইনফরমেশন) আখ্যা দিয়ে তিনি জানান, এ নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আইনজীবী উ খিন মং জো এই ধারার তথ্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘‘বিশেষায়িত তথ্য’ হলো খুবই গোপনীয় তথ্য। আরেকদিক থেকে বললে, যে তথ্যে বিশেষ ব্যক্তির প্রবেশাধিকার থাকে সেটাই ‘বিশেষায়িত তথ্য’। এটি বিশেষ মাত্রার তথ্য।
প্রেসিডেন্ট দফতরের এই অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। তবে সেনা-মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়নি তারা।
কথিত গণতান্ত্রিক উত্তোরণের নামে মিয়ানমারে আদতে জারি রয়েছে সেনাশাসন। সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্তসহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে সেনা সংখ্যাগরিষ্ঠ এই পরিষদের।