শীর্ষবিন্দু আর্ন্তজাতিক নিউজ: বিগত প্রায় সত্তর বছর ধরে যা চলে আসছিল, এক ঝটকায় ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের সেই বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে দিল্লির নরেন্দ্র মোদী সরকার যে বিরাট এক ফাটকা খেলেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই পদক্ষেপের পরিণাম যে কী হতে চলেছে, তা এখনও অনেকটাই অনুমানসাপেক্ষ।
কাশ্মিরের বেশির ভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তে যে প্রবল ক্ষুব্ধ তা আর গোপন নেই, এবং এর ফলে উপত্যকায় সশস্ত্র বিক্ষোভ নতুন করে প্রসার পাবে কি না সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
আবদুল্লা বা মুফতি পরিবারের মতো কাশ্মিরের ‘ভারতপন্থী’’ রাজনীতিকদের কিংবা হুরিয়ত কনফারেন্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের প্রাসঙ্গিকতা কতটা বজায় থাকবে সেটাও বেশ অস্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় কথা, লক্ষ লক্ষ ফৌজ মোতায়েন করে কাশ্মিরকে বাকি ভারতের সাথে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ দিল্লি নিয়েছে তা আদৌ সফল হবে কি না, মূলত সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মোদী সরকারের নাটকীয় সিদ্ধান্ত কাশ্মিরে ঠিক কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েকদিনে শ্রীনগর, দিল্লি বা মুম্বাইতে কথা বলেছি অনেকের সাথেই।
প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার ঠিক দুদিনের মাথায় যখন সেই অবরুদ্ধ ভূখন্ডে পা রাখলাম, কাশ্মিরের তরুণরা যেভাবে প্রায় ছেঁকে ধরে তাদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন সে দৃশ্য ভোলার নয়।
তারা নিশ্চিত ছিলেন, কারফিউ একবার উঠলেই কাশ্মির গর্জে উঠবে এবং দিল্লির এই পদক্ষেপ আসলে মুসলিমদের শাস্তি দেয়ারই ছল।
বাডগামের বাসিন্দা আশরাফ-মুদাসসরারা বলছিলেন, ‘মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কাশ্মিরের প্রতিটা জেলায় মুসলিমদের হেনস্থা করা হচ্ছে।’
‘গর্ভবতী মহিলারা পর্যন্ত হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তল্লাসি-চৌকি আর ফৌজি ব্যারিকেডে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে।’
স্থানীয় যুবক বিলাল আহমেদ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে দ্বিধা করলেন না, ‘অমিত শাহ-র কথামতো কাশ্মিরের আশি শতাংশ মানুষের যদি এই সিদ্ধান্তে সমর্থন থাকে, তাহলে মাত্র আট মিনিটের জন্য তিনি কারফিউ তুলেই দেখুন না কী হয়!’
কাশ্মিরী তরুণরা কোন্ পথে যেতে পারে?
কাশ্মিরের জনপ্রিয় লোকগীতি ‘মাই চানি রাওয়াম রাত দো’ যেমনটা বলে, প্রিয় জন্মভূমির জন্য এই মুলুকের যুবকরা জীবনের বহু দিন, বহু রাত উৎসর্গ করেছেন।
এখন ৩৭০ ধারা বিলোপের সবশেষ আঘাত কি তাদের আরও একবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করবে?
কাশ্মিরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ হামিদা নাঈম বানো তার হায়দারপোরার বাড়িতে বসে বলছিলেন, ‘গত দুতিন বছরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মিরে হাজারের ওপর কিশোর-যুবককে খতম করেছে। আর এখন তারা কী নতুন বার্তা দিল?’
‘এটা তো বুঝতে হবে যে এই দুর্বিষহ জীবনে হতাশ হয়েই কাশ্মিরীরা বন্দুক হাতে তুলে নিচ্ছে।’
‘নইলে কেন শিক্ষিত, প্রতিভাবান তরুণরা এমনি এমনি নিজেদের জীবন শেষ করে দিতে যাবে?’, প্রশ্ন অধ্যাপক বানোর।
বছরতিনেক আগে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যু যেভাবে কাশ্মিরী তরুণদের দলে দলে সশস্ত্র পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এখন রাতারাতি ৩৭০ ধারা মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তও একই ধরণের ট্রিগারের কাজ করবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
শ্রীনগরের রাজপুরায় গওহর বাট যেমন বলছিলেন, ‘তরুণদের যদি সরকার পাশে চায় তাহলে তাদের স্বপ্নটা কী, তা তো বুঝতে হবে!’
‘তা না-করে আপনি দুম করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলেন, এর লাভক্ষতি কী হবে সেটা তরুণদের বোঝানোর কোনও চেষ্টাই করলেন না। তা ওরা তো বিগড়ে যাবেই।’
তার বন্ধু মাজিদ পাশ থেকে যোগ করেন, ‘নিতান্ত বাধ্য হয়েই কিন্তু এই ছেলেপিলেরা পাথর ছোঁড়ে।’
‘বৃহস্পতিবার দেখলাম দুই শিক্ষিত যুবকের বাইক আটকে পুলিশ অযথা তাদের হেনস্থা করছে, মামলা দেয়ার ভয় দেখাচ্ছে।’
‘পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট একবার লাগলে তাদের চাকরি-বাকরির পথও বন্ধ, তো এই ছেলেগুলো কী করবে বলুন?’
কাশ্মিরী তরুণদের সশস্ত্র পথের দিকে ঝোঁকার আর একটা বড় কারণ হল বহু বছর ধরে সেখানে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠছে।
ভারতপন্থী কাশ্মিরীদের অবস্থান
বাদামিবাগ এলাকার ব্যবসায়ী ইরফান জাভিদ যেমন বলছিলেন, ‘এই ফারুক আবদুল্লার পরিবারকেই দেখুন না! যাদের ভরসায় গত সত্তর বছর ধরে দিল্লি এখানে রাজত্ব করল, তাদেরকেও আজ প্রমাণ দিতে হচ্ছে তারা ভারতীয় কি না।’
‘আবদুল্লা পরিবারের এই হাল হলে সাধারণ কাশ্মিরীদের কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন।’
মুম্বাই আইআইটি-র সাবেক অধ্যাপক ও লেখক-গবেষক রাম পুনিয়ানি আবার মেহবুবা মুফতির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলছিলেন, ‘একবার উগ্রপন্থীদের দিকে ঝুঁকে, একবার বিজেপির সাথে গিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজেই বিভ্রান্ত।’
‘কাশ্মির প্রশ্নে তিনি সংলাপ চেয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত করতে পারেননি সেটাও।’ অন্যদিকে মিরওয়াইজ ওমর ফারুক বা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাদের টানা গৃহবন্দী রেখে সরকার তাদের অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করে দিতে পেরেছে।
দিল্লির নিরাপত্তা থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত মনে করছেন এই পটভূমিতে এখন ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কাশ্মিরে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। তার কথায়, ‘যেটা মনে হচ্ছে মেহবুবার দল পিডিপি-র সমর্থনে ভাঁটা পড়েছে।’
‘তবে ন্যাশনাল কনফারেন্স বহু পুরনো দল, তাদের এখনও জনভিত্তি রয়েছে। আর হুরিয়ত নেতারাও বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন।’
‘এখন আমার ধারণা কেন্দ্র যেটা করতে চাইবে, নবীন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের তুলে এনে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে কাশ্মীরে কেন্দ্র-রাজ্য সমঝাতার মডেলে একটা আঞ্চলিক শক্তিকে গড়ে তুলতে চাইবে।’
‘নতুন পলিটিক্যাল ডিসপেনসেশান কাশ্মিরে আমরা বহুদিন দেখিনি, তার একটা স্পেস বোধহয় ওখানে আছে’, বিবিসিকে বলছিলেন ড: দত্ত।
কাশ্মিরে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা কি প্রভাব ফেলতে পারে
কিন্তু কাশ্মিরে দিল্লির সমর্থনপুষ্ট কোনও নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হলেই কি বাকি ভারতের সাথে কাশ্মিরের আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব?
কাশ্মিরের নবীন রাজনীতিবিদ ও জেএনইউ-র সাবেক ছাত্র-নেত্রী শেহলা রশিদ কিন্তু মনে করেন, ‘এই তথাকথিত ইন্টিগ্রেশনের তত্ত্বটা একেবারে অবাস্তব।’
তার প্রশ্ন, ‘যেখানে অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের ভ্যালি থেকে এয়ারলিফট করে কিংবা ভারতীয় পর্যটকদের বিদেশিদের ডিপোর্ট করার মতো করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করতে হয়, সেখানে কীভাবে ইন্টিগ্রেশন সম্ভব?’
‘আমি তো বলব মোদীজি স্রেফ লোকের চোখে ধুলো দিচ্ছেন!’
কাশ্মির গবেষক রাম পুনিয়ানও বলছিলেন, ‘একটা ভূখন্ডকে নিজের দেশে যুক্ত করার দুটো রাস্তা আছে। একটা হল সেই সমাজের গণতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে, ভরসার সেতু গড়ে এবং তাদের হৃদয় বা মন জিতে নিয়ে।’
‘আর দ্বিতীয় পথটা হল সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে, ঠিক যেটা এখন ভারত করছে।’
লক্ষ লক্ষ ফৌজ ও আধাসেনা পাঠিয়ে পুরো কাশ্মিরকে হয়তো কিছুদিন গ্যারিসন বানিয়ে রাখা সম্ভব, তবে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য একটা কার্যকরী রাজনৈতিক রোডম্যাপ অপরিহার্য।
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা সব সময় কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলি, এত সুন্দর জায়গা – অথচ সেখানে প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন কিন্তু তেমন হয়নি কখনওই। শিক্ষা-শিল্পসহ নানা খাতে বাকি ভারতে যে ধরনের বিনিয়োগ হয়েছে, কাশ্মীরে সেটা কোথায়?’
‘অথচ দিল্লি-চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোরে তরুণরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, সেই একই ধরনের অ্যাকসেস যদি আমরা কাশ্মীরকেও দিতে পারি তাহলে সেখানেও আমরা ইতিবাচক সাড়া পেতে পারি বলেই আমার বিশ্বাস।’
দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় ভরদ্বাজও বলছিলেন, ‘প্রায় দুদশক আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কাশ্মিরের মন জেতার জন্য বলেছিলেন জমহুরিয়ত, কাশ্মিরিয়ত আর ইনসানিয়তের কথা – যার অর্থ হল যথাক্রমে গুড গভর্ন্যান্স বা সুশাসন, কাশ্মীরি জাতিসত্ত্বা আর মানবিকতা।’
প্রফেসর ভরদ্বাজের বক্তব্য, ‘অন্য সব মডেল তো সত্তর বছর সময় পেল, এখন এটাকেও একটু সময় দিয়ে দেখাই যাক না – কাশ্মিরের মানুষ তা গ্রহণ করেন কি না!’
কাশ্মিরের বহুত্ববাদ রক্ষার প্রয়োজন
কাশ্মিরের একটা খুব পুরনো গান ‘হুক্কুস বুক্কুস’ এখন পুরো ভারত শুনছে। বলিউড ফিল্মে যেমন ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি গাইছেন কাশ্মিরী পন্ডিত সমাজের সঙ্গীতিশিল্পী আভা হানজুরা, যিনি থাকেন ব্যাঙ্গালোরে।
মিলিট্যান্সি আর মিলিটারির হাতে বুলেটবিধ্বস্ত কাশ্মিরের যে অন্য একটা চেহারাও আছে, তার সাথে বাকি ভারতের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার নানা ধরনের চেষ্টা চলছে।
ইতিহাসবিদ মহুয়া সরকারের কথায়, ‘কাশ্মিরের মধ্যে চিরকালই কিন্তু একটা প্লুরালিজম ছিল, এবং সেটা এখনও আছে।’
‘কলহনের রাজতরঙ্গিণী যেখানে লেখা, তার ইতিহাস আবহমানকাল ধরে বহুত্ববাদকে সম্মান করে এসেছে। ভারতের কাছে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘এখন আমার বিশ্বাস, যতটা সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে ও ডেমোক্র্যাটিক পন্থায় সেটা রক্ষা করা যায় ততই ভাল!’
অর্থাৎ তিনিও কাশ্মিরের সেই বহুত্ববাদকে রক্ষা করার কথাই বলছেন – তবে যতটা সম্ভব গণতান্ত্রিক পথে।
সমস্যা হল, ৩৭০ ধারা বিলোপের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কাশ্মিরের ওপর আচমকাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতে সেখানে কাশ্মিরের মতামত নেয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি।
কাশ্মিরের গরিষ্ঠসংখ্যাক মানুষ প্রাণপণে তা রুখতে চাইছেন, ফলে সেই সংঘাতের পরিণতি উপত্যকায় শান্তি ও সমৃদ্ধি ডেকে আনবে তা এখন বিশ্বাস করা রীতিমতো অসম্ভবই মনে হচ্ছে!