গোলাম মওলা: ব্যাংকের কাছে ঋণ ও আমানতের হিসাব আছে। জমিসহ সম্পদের হিসাবও আছে। তবে হিসাবের সমপরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকের কাছে নেই। আর্থিক খাতের গোয়েন্দারা বলছেন, ব্যাংক খাত এখন টাকা পাচারের প্রধান মাধ্যম। আমদানি ও রফতানির কথা বলে এই বৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে টাকা সব ডলার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
অর্থ পাচারের প্রকৃত হিসাব কারও কাছে না থাকলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু ব্যাংক খাতের মধ্য দিয়েই প্রতি বছর ৪০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও প্রচুর টাকা পাচার হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে দেশের ব্যাংকগুলোতে গত কয়েক বছর ধরেই টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ পাচারের আগেই তা চিহ্নিত করা ও পাচাররোধে সম্ভাব্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘অর্থ পাচার প্রতিরোধে আমরা এখন কঠোর অবস্থানে আছি। এরইমধ্যে আমরা একটি নীতিমালা করেছি। অর্থ পাচার মনিটরিং করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে একটি করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এর কোনও প্রকৃত তথ্য নেই জানিয়ে বিএফআইইউ’র প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমদানির সব তথ্য পর্যালোচনা করে অস্বাভাবিক আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এমন কয়েকটি ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া সব ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেন যাচাই করা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর আমদানি-রফতানি তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এগুলো দেখার জন্য একজন উপ-মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকে টাকার সংকট, তার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। এই হার গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।’
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক অস্থিরতা তথা বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার সময়ও (২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত) বেসরকারি খাতে এত কম প্রবৃদ্ধি ছিল না। ২০১৩ সালে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১৪ সালে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
এদিকে বিএফআইইউ থেকে বলা হচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থের ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, আর্থিক গোয়েন্দারা যতগুলো কেস বিএফআইইউর কাছে পাঠিয়েছে তার বেশির ভাগই বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের হার সবেচেয়ে বেশি। আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। যেসব পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কম, যেমন মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদি বা যেসব পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণ কঠিন সেসব পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রফতানি করা পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে অবশিষ্ট অর্থ বিদেশে রেখেও অর্থ পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি করা পণ্যের বিবরণ পরিবর্তন করে বা কোনও পণ্য আমদানি না করে শুধু ডকুমেন্টের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করেও অর্থ পাচার হচ্ছে। তাছাড়া, একই পণ্য বা সেবার একাধিক চালান ইস্যুকরণ, ঘোষণার তুলনায় পণ্য বা সেবা বেশি বা কম জাহাজীকরণের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যও বলছে, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক সমীক্ষায় অর্থ পাচারের একই চিত্র উঠে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও মনে করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা পাচার (মানি লন্ডারিং) হয় আমদানি-রফতানির নামেই। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) বৈশ্বিক সূচকে দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা পাচার হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সবশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে জিএফআই। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
২০১৪ সালের জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের প্রকাশিত তথ্য অনুযাযী, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে সিংহভাগ অর্থ পাচার হয়। আঙ্কটাডের দেওয়া তথ্য বিবেচনা করলে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘ব্যাংকে টাকা না থাকার অন্যতম কারণ টাকা পাচার। তার মতে, শুধু ব্যাংক খাতের মধ্য দিয়েই প্রতি বছর প্রায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও প্রচুর টাকা পাচার হচ্ছে বলে মন্তব্য তার। টাকা পাচার একটি দুশ্চিন্তার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে এর কোনও প্রকৃত তথ্য নেই। প্রতি বছর যেভাবে টাকা পাচার হচ্ছে, তাতে গত ১০ বছরে ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ পাচার হয়েছে বলে তার ধারণা। এই ৬ লাখ কোটি টাকার অধিকাংশই ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও বিনিয়োগ জটিলতার কারণে সাধারণত মুদ্রাপাচার হয় বলে মনে করেন তিনি। আইন করে বা নীতিমালা করে টাকা পাচার রোধ করা যাবে বলেও মন্তব্য তারা। টাকা পাচার রোধ করতে হলে অবৈধ সোর্স বা অবৈধভাবে টাকা আয় করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। যদিও এটি একটি কঠিন কাজ। কারণ, অবৈধ সোর্স অব ইনকাম কারা করে, তা সবাই জানে। কিন্তু, তাদের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায় না।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘টাকা পাচারের ৮০ শতাংশই হয় আমদানি-রফতানির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে। এটা ব্যাংকিং খাতের মধ্যে দিয়ে পাচার হচ্ছে।’
বিআইবিএম’র অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পণ্যের ঠিক মূল্য যাচাই করার ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাফিলতি রয়েছে। যে কারণে অর্থ পাচারকারীরা সুযোগ নিচ্ছে।’