আদনান রহমান: ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে ওমানের মাস্কাট যাচ্ছিল ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজ। পথে ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে ভারতের ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরের স্বামী বিবেকানন্দ বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। ছয় বছর ধরে সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় এখনো পড়ে আছে রায়পুর বিমানবন্দরে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজ
দীর্ঘদিন চিঠি দিয়েও উড়োজাহাজটি বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেনি রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অবশেষে নিলামে উঠিয়ে নিজেদের টাকা আদায়ের কৌশল অবলম্বন করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
২০১৫ সালে ১৭০ আসনের ম্যাকডনেল ডগলাসের এমডি-৮৩ মডেলের উড়োজাহাজটি রায়পুরে অবতরণ করে। ক্রু-পাইলটসহ যাত্রী ছিল মোট ১৭৩ জন। ঘটনার ২০ দিন পর ইঞ্জিনের সমস্যা দূর করতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ থেকে ইঞ্জিনিয়ার পাঠানো হয়। তারা উড়োজাহাজটি চলার উপযুক্ত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজটি না নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন তারা। এরপর তিন বছর পার্কিং বে’তে পড়েছিল সেটি। ২০১৮ সালে বিমানবন্দরের সীমানার ভেতরে পরিত্যক্ত একটি স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজটি।
২০১৫ সালে ১৭০ আসনের ম্যাকডনেল ডগলাসের এমডি-৮৩ মডেলের উড়োজাহাজটি রায়পুরে অবতরণ করে। ক্রু-পাইলটসহ যাত্রী ছিল মোট ১৭৩ জন। ঘটনার ২০ দিন পর ইঞ্জিনের সমস্যা দূর করতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ থেকে ইঞ্জিনিয়ার পাঠানো হয়। তারা উড়োজাহাজটি চলার উপযুক্ত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজটি না নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন তারা। এরপর থেকে সেটি পড়ে আছে রায়পুর বিমানবন্দরে
২০১৫ সাল থেকেই শুরু হয় চিঠি চালাচালি। রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সেখানে উল্লেখ করে, রায়পুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি এমনিতেই অনেক ছোট। এখানে একসঙ্গে ছয়টি উড়োজাহাজ রাখার ব্যবস্থা আছে। ইউনাইটেডের পাইলট যখন উড়োজাহাজটি অবতরণের কথা বলেন তখন রানওয়েসহ আশপাশের স্থান খালি করে জরুরি অবতরণের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতিদান হিসেবে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিমানবন্দরের ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’ (আন ওয়েলকাম গেস্ট) হিসেবে কোনো চার্জ না দিয়ে জায়গা দখল করে রেখেছে।
ছয় বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রায়পুর বিমানবন্দরে পড়ে আছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজটি; ছবি- শিভেন্দ্র শুকলা
রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রথম বছর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে ১২টি চিঠি দেওয়া হয়। একটি চিঠির প্রতিউত্তরে ইউনাইটেড ‘দু-তিন মাসের মধ্যে সুরাহা’র কথা বললেও সেটি এখনো হয়নি।
রায়পুর বিমানবন্দরে কোনো উড়োজাহাজ অবস্থান করলে প্রতি ঘণ্টার জন্য পার্কিং চার্জ দিতে হয় ৩২০ ভারতীয় রূপি। বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে তাদের পাওনা এক কোটি ৫৪ লাখ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা)। এখন তারা নিলামের মাধ্যমে উড়োজাহাজটি বিক্রি করে সমুদয় টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি তারা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছে।
রায়পুর বিমানবন্দরে কোনো উড়োজাহাজ অবস্থান করলে প্রতি ঘণ্টার জন্য পার্কিং চার্জ দিতে হয় ৩২০ ভারতীয় রূপি। বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে তাদের পাওনা এক কোটি ৫৪ লাখ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা)। এখন তারা নিলামের মাধ্যমে উড়োজাহাজটি বিক্রি করে সমুদয় টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি তারা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছে
রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, সর্বশেষ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চিঠির মাধ্যমে তারা ‘নিলাম প্রক্রিয়ার দিকে এগোনোর’ বিষয়টি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে জানায়। পাশাপাশি এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এএআই) ও রিজিওনাল হেডকোয়ার্টারের (আরএইচকিউ) মাধ্যমে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবগত করে। তবে ওই চিঠিরও জবাব দেয়নি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম
অবশেষে জবাব দিয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পর্ষদ
উড়োজাহাজ নিলামের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নবগঠিত পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা গত পাঁচ বছর ধরে অনেকবার যোগাযোগ করেছে সাবেক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তারা কোনো উত্তর দেয়নি। কোনো সাড়াশব্দও দেয়নি। ফলে রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিলামের উদ্যোগ নেয়।’
‘আমরা আসার পর তাদের চিঠি দিয়েছি, অকশন (নিলাম) যাতে না হয়। আমরা তাদের (রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ) কাছ থেকে ছয় মাস সময় চেয়েছি। চিঠিতে বলেছি, উড়োজাহাজটি নিলামে না তুলে আমাদের যেন ছয় মাসের সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে তাদের জানিয়েছি। তবে তারা এখনো আমাদের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি।’
আমরা আসার পর তাদের চিঠি দিয়েছি, অকশন (নিলাম) যাতে না হয়। আমরা তাদের (রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ) কাছ থেকে ছয় মাস সময় চেয়েছি। চিঠিতে বলেছি, উড়োজাহাজটি নিলামে না তুলে আমাদের যেন ছয় মাসের সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে তাদের জানিয়েছি। তবে তারা এখনো আমাদের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নিকাজী ওয়াহিদুল আলম, চেয়ারম্যান, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পরিচালনাপর্ষদ
টাকা চেয়ে পাচ্ছে না খোদ সিভিল এভিয়েশন
অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ মিলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে মোট ২০৩ কোটি টাকা পায় বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আটটি উড়োজাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিনই বাড়ছে তাদের চার্জ, অথচ আয় না থাকায় টাকা পরিশোধের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুধু বেবিচক নয়, আমাদের আরও অনেক দায়দেনা আছে। সবমিলিয়ে আমরা একটা ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরি করছি। আমরা কীভাবে দায়দেনাগুলো পরিশোধ করব, সেটা ঠিক করছি। তবে বকেয়া নিয়ে আমরা বেবিচকের সহযোগিতা চাই। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করব।’
পাওনা আদায়ের বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের কাছে আমাদের মোট পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওনা। সেগুলো আদায়ে আলোচনা চলছে। প্রয়োজনে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেওয়া বা চার্জ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।’
শুধু বেবিচক নয়, আমাদের আরও অনেক দায়দেনা আছে। সবমিলিয়ে আমরা একটা ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরি করছি। আমরা কীভাবে দায়দেনাগুলো পরিশোধ করব, সেটা ঠিক করছি। তবে বকেয়া নিয়ে আমরা বেবিচকের সহযোগিতা চাই। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করবকাজী ওয়াহিদুল আলম, চেয়ারম্যান, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পরিচালনাপর্ষদ
২০০৫ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ২০০৭ সালে প্রথম ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। সংস্থাটি অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুর ও ঈশ্বরদী এবং দেশের বাইরে জেদ্দা, মাস্কাট, দোহা, কুয়ালালামপুর, কাঠমান্ডু, ব্যাংকক ও কলকাতা রুটে ফ্লাইট চালায়। ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পরিচালন ব্যয় জোগান দিতে না পারায় ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয়। দুদিন পর আবারও তারা ফ্লাইট চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ২০১৬ সালে একসঙ্গে কয়েকটি উড়োজাহাজে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় তারা ফ্লাইট অপারেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকে আর চালু হয়নি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ।
বিনিয়োগকারীদের ডুবিয়েছে ইউনাইটেড
জানা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০১০ সালের পর থেকে ১১ বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। পাঁচ বছর ধরে তাদের কার্যক্রম বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির ৫ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করে ছিলেন উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা। তাই বাকি ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীর স্বার্থে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনাপর্ষদ ভেঙে নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসি।
ওই সাতজনের মধ্যে এভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এছাড়া পরিচালক করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাদিকুল ইসলাম, মাকসুদুর রহমান সরকার, এ টি এম নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস ও মোহাম্মদ শাহনেওয়াজকে।
Leave a Reply