ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পেশাজীবীদের উদ্যোগে ‘দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি: জাতি গঠনে তারা কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেন’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৬ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় লন্ডন স্কুল অব কমার্স এন্ড আইটি-এর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে বক্তারা বলেন, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন নিয়মিতভাবে দিনের পর দিন। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে অর্ধশত প্রবাসী জেল খেটেছেন।
সর্বশেষে প্রবাসীরা ৫ আগস্টের আগে মাসব্যাপী রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সুতরাং দেড় কোটি প্রবাসীকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
এয়ারপোর্টে ভিআইপি মর্যাদা নয়, বরং বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে অন্যান্য নাগরিকদের মতো প্রবাসীদের অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আকুণ্ঠ সমর্থন আছে। যে কোন উপায়ে এই সরকারকে সফল হতেই হবে। সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।
এই সুযোগ থেকে প্রবাসীদের বঞ্চিত করলে বরং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পৃথিবীর প্রায় ১৫টি স্বাধীন দেশ আছে যাদের মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি হবে না। সুতরাং এত বিপুলসংখ্যক প্রবাসীদের অবহেলা করে রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয়।
দেড় কোটি প্রবাসীদের খুশি করেন ও তাদের ন্যায্য এবং যৌক্তিক দাবিসমূহ মানেন, তার বিনিময়ে দেখবেন প্রবাসীরা কোটি কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দেশকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেটর নাসরুল্লাহ খান জুনায়েদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবং প্রতিথযশা আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাজির আহমদের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ওলিউল্লাহ নোমান।
এতে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র সাবেক শিক্ষক ও কমনওয়েলথ স্কলার ড. কামরুল হাসান, বাংলাদেশের সাবেক জজ ব্যারিস্টার মুজিবুর রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সুরমা সম্পাদক সামছুল আলম লিটন, বুয়েটের সাবেক ভিপি ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যারিস্টার তারেক আজিজ, শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ শাহ আলম, ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেন, ব্রিটিশ হাসপাতালের সাবেক কনসালটেন্ট ডা: সাইফউদ্দিন কিসলু, সময় সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, কৃষিবিদ আকবর হোসেন, এডভোকেট সাইফুর রহমান, ব্যারিস্টার আফিন্দি লিটন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমিন চৌধূরী, ব্যারিস্টার নূরুল গাফফার, সলিসিটর মেহেদি হাসান, পিএইচডি গবেষক খালেদ ইয়াহইয়া, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হাফিজ মুহাম্মদ ইমরান, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, কমিউনিটি নেতা শফিক খাঁন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এমদাদুল হক, যুবনেতা নাসির উদ্দিন, মানবাধিকার কর্মী শাহ মুহাম্মদ উজ্জ্বল, সমাজকর্মী আমিনুল ইসলাম প্রমূখ। অনুষ্ঠানের শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানান সেমিনারের অন্যতম আয়োজক ব্যারিস্টার আলিমুল হক লিটন।
সেমিনারে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা ও দাবি জানানো হয়:
১. প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছেন। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। চার লক্ষ চাকমাদের জন্য প্রতিটি সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে দেড় কোটি প্রবাসীদের জন্য কোনো সরকারেই প্রবাসী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেড় কোটি প্রবাসীদের মধ্য থেকে অন্তত: দুইজন উপদেষ্টা রাখার দাবি জানাচ্ছি।
২. প্রবাসীদের ন্যায়সঙ্গত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও অভিযোগ আছে। এসব ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া ও অভিযোগ অতীতে সরকারের কাছে পাঠালেও যথাযথ বা সন্তুোষজনক জবাব পাওয়া যায়নি। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স হচ্ছে দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। এই খাতকে মোটেই অবহেলা করা ঠিক নয়। তাই প্রবাসীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, সার্ভিসের মান ও অভিযোগ – এসব বিষয়ে সংস্কারের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
৩. ব্রিটেন, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন অনেক বাংলাদেশি দ্বৈত-নাগরিক। অনেকে প্রায়োগিক সুবিধার্থে দ্বৈত-নাগরিকত্ব নিলেও তারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব কেউ কেড়ে নিতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকরা সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিকরা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, এমনকি প্রধান বিচারপতি হতে পারলেও এমপি হওয়ার পথে সাংবিধানিক বাঁধা ও বৈষম্য রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রের সুতিকাগার ব্রিটেনে দ্বৈত নাগরিকরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার হতে পারবেন। শুধু তাই নয় ব্রিটেনে এমপি হওয়ার জন্য বৃটিশ নাগরিক হওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ব্রিটেনে সেটেল্ড যে কেউ ব্রিটিশ এমপি হতে পারবেন। সুতরাং জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক যারা দ্বৈত-নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদের জন্য সংবিধানের বৈষম্যমূলক ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
৪. প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছেন। সবাইকে এক পাল্লায় রেখে একভাবে দেখা উচিৎ নয়। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের তেমন কোনো অবস্থান বা অধিকার না থাকলেও ব্রিটেনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিরা সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানে শত শত দক্ষ প্রফেশনাল আছেন যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছেন। হাজার হাজার অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও লন্ডন গ্রেজ্যুয়েট আছেন যারা বাংলাদেশ পূনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আধুনিক মালয়েশিয়া নির্মাণে মালয়েশিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মুহাম্মদ ব্রিটেনে এসে ব্রিটিশ- মালয়েশিয়ানদের মধ্যে ট্যালেন্ট হান্ট করতেন। এমনটি করা জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা বাংলাদেশ থেকে তেমন কিছু নেয়ার না থাকলেও দেয়ার মতো তাদের অনেক কিছু আছে।
৫. ব্রিটেন থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে ভেলিড বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে গত ২/৩ বছর আগে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সাথে ভেলিড বাংলাদেশি পাসপোর্টের সম্পর্ক কি তা বোধগম্য নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন আজগুবি নিয়ম নেই। এই নিয়ম চালু করার কারণে লক্ষ লক্ষ ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসীরা মারাত্মক ঝামেলায় পড়েছেন। এমতাবস্থায়, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদনে আইডি হিসেবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট অথবা ব্রিটিশ পাসপোর্ট অথবা এনআইডি কার্ড গ্রহণযোগ্য বলে অতিসত্ত্বর প্রজ্ঞাপন জারির জোর দাবি জানাচ্ছি।
৬. বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অথচ যাদের ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তাদের সাথে সুযোগ-সুবিধায় বিরাট বৈষম্য রয়েছে। যেমন-এমপি হলেই ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বরাদ্দসহ নানা বরাদ্দ দেওয়া হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের মালিক তথা ভোটারদের বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত না হলেও এমপি সাহেবদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে বিরাট বৈষম্য তৈরি করে। অথচ সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সকলেই সমান। অবিলম্বে এসব বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না এমপিদের।
Leave a Reply