মলয় ভৌমিক |
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তাঁর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি নিউইয়র্কে ভারতীয় দূতাবাসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে গ্রেপ্তার ও হেনস্তার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে গত বুধবার দুঃখ প্রকাশে বাধ্য হয়েছেন। দেবযানী হেনস্তার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ দেবযানীকে মুক্ত করা এবং তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে না পারলে পার্লামেন্টে আর প্রবেশ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেছিলেন।
সালমান খুরশিদের অঙ্গীকার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এ কারণে যে ঘটনার প্রতিপক্ষ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ রকম এক শক্তিধরের বিরুদ্ধে অবস্থান তিনি নিতে পেরেছিলেন তাঁর পেছনে দলমত-নির্বিশেষে গোটা জাতি এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বলে। দেশ ও জাতির মর্যাদার প্রশ্নে, পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আদর্শিক দিক থেকে বিপরীত মেরুতে অবস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাওয়ার নজির ভারতে এর আগেও বহুবার লক্ষ করা গেছে।
দুর্ভাগ্য আমাদের, পাশের দেশ ভারত যা পারছে, আমরা তা পারছি না। দেশ ও জাতির মর্যাদার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ এখন আমাদের কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিচারিক সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার শাস্তি কার্যকরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান যে আচরণ দেখিয়েছে, দেবযানীর হেনস্তার ঘটনার তুলনায় তা পর্বতপ্রমাণ অশিষ্ট। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কাদের মোল্লার বিষয়ে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূতই নয়, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি অসম্মানজনক। অথচ নজিরবিহীন এই অপকর্ম এ দেশের একশ্রেণীর ব্যক্তি ও দলের জাত্যভিমানে বিন্দুমাত্র ঘা দিতে পেরেছে বলে মনে হলো না। আবার জাতির অহংকারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যাঁরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন, তাঁদের কপালে বাড়তি জুটল পুলিশের লাঠির ঘা।
একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে না পেরে এবং সে কারণে এ দেশে জামায়াতসহ কিছু ধর্মপছন্দ দলকে ক্রমাগত সক্রিয় রাখার স্বার্থে পাকিস্তান তাদের পার্লামেন্টে কী করল, সেটি বড় বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা কী করলাম এবং আমরা কী করছি? জামায়াতসহ ওই দলগুলো এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে কখনোই বিশ্বাস করে না। তাদের কাছ থেকে তাই প্রত্যাশা নেই। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নীরবতা তো আমাদের হতবাক করে দিল। দেশ ও জাতির মর্যাদার প্রশ্নে দায়িত্বশীল কোনো দল নিশ্চুপ হয়ে থাকলে দেশপ্রেমিক নাগরিকের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হওয়াই হবে স্বাভাবিক। এখন মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের নগ্ন নাক গলানোর ঘটনা এ দেশের কিছু দল ও মানুষের অহংবোধে বিন্দুমাত্রও ধাক্কা দিতে পারেনি।
জাত্যভিমান সব জাতিরই আছে। কিন্তু জাতি হিসেবে অহংকার করার মতো সম্পদ আমাদের ভাঁড়ারে যা সঞ্চিত আছে, পৃথিবীর কম জাতিরই তা আছে। ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কোনো জাতি এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকারের ইতিহাসও কারও নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিও আমাদের অহংকারের ফসল। এই ইতিহাসের চেয়ে হূদয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ ধারণ কি গৌরবের? আমরা এ কোথায় নেমে যাচ্ছি? জাতির অহংকারের ইতিহাসকে পদদলিত করে কেবল ভোট-ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ কষে কত পথ হাঁটা যাবে?
আমরা বলছি যে পাকিস্তান চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে আমাদের অনৈক্যই সুযোগ করে দিয়েছে এমন ধৃষ্টতা দেখানোর। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে অনেক দেশের প্রকাশ্য নাক গলানোর সুযোগও তৈরি করেছে এই অনৈক্য। সন্দেহ নেই, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট যা করেছে, তা স্থূলবুদ্ধির কাজ। কিন্তু স্থূলবুদ্ধির কাজটি ঘটেছে পেছনের সূক্ষ্মবুদ্ধির ফল হিসেবেই। আমাদের সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকরের ঘটনা আমাদের চোখের সামনে একটি গোটানো ছাতা খুলে দিল। আমাদের প্রত্যক্ষণ-ক্ষমতায় ওই গোটানো ছাতার মধ্যে কী কী বস্তু লুকানো ছিল, তা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারব, ততই জাতির জন্য মঙ্গল।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ব্যাপারে চীন কখনো সক্রিয় হয়েছে, এমনটি আমরা মনে করতে পারি না। সেই চীন বিগত কয়েক মাস হলো বাংলাদেশের ব্যাপারে অতি উৎসাহ দেখিয়ে আসছে। চীনের এই আচরণে খটকা লাগছে অনেকের মনেই। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রাজনীতির ব্যাপারে নানা কারণে সব সময়ই সক্রিয়। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর হওয়ার মাত্র কদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে কাদের মোল্লা প্রসঙ্গ টেনে আনবেন—এমনটা আমরা ভাবতে পারিনি। কূটনৈতিক সংস্কৃতিতে ভাষা বা শব্দপ্রয়োগের বিশেষ রীতি আছে। জন কেরির সেই ‘ভদ্রোচিত’ বাক্য বিশ্লেষণ করলে বুঝতে কষ্ট হয় না তিনি প্রধানত কাদের মোল্লার পক্ষ নিয়েই প্রধানমন্ত্রীকে ফোনটি করেছিলেন। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর করা যথাযথ হবে কি না’ তাঁর এমন বক্তব্যের কূটনৈতিক অর্থকে যদি ‘প্রচ্ছন্ন হুমকি’ বলা হয়, বোধ করি তা অত্যুক্তি হবে না। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি যে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি আমাদের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল।
জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এসেছিলেন দুই পক্ষকে সংলাপে বসাতে। বাংলাদেশে তিনি উপস্থিত থাকা অবস্থায় একই বিষয়ে মহাসচিব বান কি মুন আবার কেন প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলেন, তা হূদয়ঙ্গম করতে আমাদের কষ্টই হচ্ছিল। অবশ্য পরে কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে তিনি তাঁর ফোন করার কারণটি পরিষ্কার করে দেন।
এদিকে তারানকোই বা কী করলেন? সচেতন মানুষমাত্রই বিশ্বাস করেন, জাতিসংঘ যদি ‘আগে সহিংসতা বন্ধ করো, তারপর আলোচনায় বসো’—এই নীতি গ্রহণ করত, তাহলে কোনো পক্ষই ‘সহিংসতার কর্মসূচি’ নিয়ে অগ্রসর হতে সাহস পেত না। আলোচনায় সরকারপক্ষও নমনীয় হতে বাধ্য হতো। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিও অগ্রহণযোগ্য। ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন ও কর্নেল গাদ্দাফির ব্যাপারে তারা কিন্তু নীরব। পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় আর বাংলাদেশে আগুনে পুড়িয়ে এবং হাত-পায়ের রগ কেটে প্রতিদিন মানুষ খুনের ব্যাপারেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক ‘মুরব্বি’ দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের মূল ইস্যু যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়, বরং মূল ইস্যু হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ দেশে পাকিস্তানের পোষ্যদের সহিংসতার উৎসও একই সুতোয় গাঁথা। এত সব শক্তিধর দেশ ও সংস্থার চাপের মুখে শেখ হাসিনা নতিস্বীকার করেননি। এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পরেন।
গোটানো ছাতা খোলার পর তার মধ্য থেকে আরও দুটো সত্যও বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের শোক প্রস্তাবে কাদের মোল্লাকে পাকিস্তানের সেনা হিসেবে উল্লেখ করায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এত দিন যত আড়াল করার চেষ্টাই হোক না কেন, জামায়াত একাত্তরেও পাকিস্তানের সেনা ছিল, এখনো পাকিস্তানের সেনাই রয়ে গেছে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের লাহোরে জামায়াতের প্রতিবাদ মিছিলে তেহরিক-ই-তালেবান প্রকাশ্যে অংশ নেয়। এই তেহরিক-ই-তালেবানই পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। নিষিদ্ধ এ সংগঠন যে জামায়াতের ‘অপারেশন’ উইং, এ ব্যাপারে এখন আর সন্দেহ নেই। যশোরে উদীচীর ওপর বোমা হামলা থেকে শুরু করে দেশে বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতা এবং বাংলা ভাইয়ের উত্থানের পর কিন্তু বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল, এসব সংগঠন মূলত জামায়াতই সৃষ্টি করেছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে তেহরিক-ই-তালেবানের প্রকাশ্য অবস্থানের পর তো সেই সত্যটিই বেরিয়ে এল। যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে মডারেট মুসলিম দল হিসেবে সনদ দিয়ে আসছে। এবার তারা কী বলবে? বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ধরন দেখেও কি তাদের বোধোদয় হবে না?
আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারার অনৈক্যের ফাঁক গলেই আজ ঘটছে নানা শক্তির নিজ নিজ স্বার্থের খেলা। আর এ খেলায় হেরে যাচ্ছি আমরাই। নিয়ত রক্তের হোলি খেলার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জাতীয় ঐক্য খুবই জরুরি। তবে তার চেয়েও জরুরি কথা হলো যে ঐক্যে খাদ থাকে, সে ঐক্য ক্ষণস্থায়ী। অতীতের এমন অনেক ক্ষণস্থায়ী ঐক্য থেকেই আমাদের এ শিক্ষা নিতে হবে। দেশের স্বার্থে ঐক্যের প্রধান শর্ত হলো দেশকে ভালোবাসা। যারা দেশকে ভালোবাসে না, দেশের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না, তাদের নিয়ে ঐক্য হয় না। হূদয়ে পাকিস্তান আর আচরণে ‘তালেবান’দের ভোটের ও ক্ষমতার হিসাব-নিকাশের মধ্যে ধরে অগ্রসর হলে জাতীয় ঐক্য কখনোই আসবে না, আরও রক্তাক্ত হবে দেশ। দেশকে আরও রক্তাক্ত করার দায় কোনো পক্ষ নেবে কি?
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাট্যকার।