ইলিয়াস সরকার: আবেদনটি ছিলো বাংলায়। আইনজীবী সেটা বাংলাতেই দাখিল করেছিলেন। বিচারক আদেশও দিয়েছেন বাংলায়।এর আগে বাংলায় রায় ঘোষণা হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলার। কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় দিয়ে আলোচিতও হয়েছেন। তবে এসবই ছিল ব্যতিক্রম।
আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেলেও খোদ বাংলাদেশের উচ্চ আদালতেই বাংলা আজো অবহেলিতই রয়ে গেছে। আর তাই উচ্চ আদালতে সব আবেদন এখনো ইংরেজিতেই করা হয়। রায়ও হয় ইংরেজিতে। আবার আইনজীবীরা সাবমিশনও রাখেন ইংরেজিতে।
দেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ১৯৮৭ সালে আইন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহার করা যাবে বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ‘সুপ্রিমকোর্ট রুলস’ অনুযায়ী উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের থেকে আদেশ বা রায় পর্যন্ত সবই দেওয়া হয় ইংরেজিতে।
প্রচলিত এই ধারার বাইরে এসে ভাষার মাসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মো. ইউনুছ আলী আকন্দ উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন করার নির্দেশনা চেয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে বাংলায় একটি আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের আদালত ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড এবং সব ধরনের নাম্বার ও নেইমপ্লেটে এক মাসের মধ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার নির্দেশ দেন ।
এছাড়া অনতিবিলম্বে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২নং আইন) বাস্তবায়নে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না, আইনটি বাংলাদেশের সর্বত্র অনুসরণ করার জন্য কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না এবং এই আইনের ৪ ধারামতে প্রয়োজনীয় বিধি/সার্কুলার জারি/প্রকাশ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
দুই সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, সংস্কৃতি সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
ইউনুছ আলীর আবেদনে বলা হয়, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২নং আইন) পাস হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। কিন্তু দীর্ঘ ২৬ বছরেও আইনটি সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
আইনের ধারা ৩ উপ-ধারা (৩) অনুযায়ী ‘৩(৩) যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’
আবেদনে বলা হয়, সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা এই আইন ঢালাওভাবে অমান্য করলেও এ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে সরকারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ইউনুছ আলীর অভিযোগ, আইনটি বাস্তবায়নে সরকার নিষ্ক্রিয় এবং সরকার অনেক ক্ষেত্রেই কোনো রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নাম, চিঠিপত্র আদান প্রদান, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলির কোনোটাই বাংলায় লেখা হচেছ না। সরকারী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের কার্যক্রমেও বাংলা ভাষার প্রচলন হচ্ছে না।
ইউনুছ আলীর আবেদনে আরো বলা হয়, কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী শব্দ বহাল রেখে আইনও করে। যেমন- ‘বাংলাদেশ রাইফেলস’র নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (BGB) করা হয়েছে। ইংরেজি শব্দ বহাল রেখে নাম পরিবর্তন করে পাশ করা আইনটি সংবিধানের ৩/৭/২৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেন ইউনুছ আলী।
একইভাবে দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশনসহ অন্যান্য মিডিয়ার বিজ্ঞাপনেও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়। Channel-9, BTV World, ATN Banla, ATN News, Bangla vision, Channel-I, Channel-24, ETV, RTV, NTV, My TV, GTV-এর ইংরেজি নাম ব্যবহারের উল্লেখ করে সম্প্রচার মাধ্যামগুলোর প্রচার প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনেও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ব্যবহারের উদাহরণ টানেন ইউনুছ আলী।
আবেদনে গাড়ির নম্বর প্লেটে অনেক ক্ষেত্রে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ব্যবহারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এরকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ অনুসরণ করা হচ্ছে না, যা আইনের ৩(৩) ধারা অনুসারে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার আইন রয়েছে। আইনের ৪ ধারা অনুসারে ‘সরকার সরকারী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবেন।’ কিন্তু এ বিষয়ে সরকার এতো নিষ্ক্রিয় যে, আইনটি সর্বত্র প্রচার এবং বাস্তবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বিধিমালা বা সার্কুলার পর্যন্ত জারি করেনি।
ইউনুছ আলীর এ আবেদনের শুনানিতে বিচারক বাংলায় কথা বলেছেন। আদেশটিও বাংলায় দিয়েছেন বলে জানান ওই আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়।
উচ্চ আদালতে ভাষা আন্দোলন ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংক্রান্ত একটি রিটের রায় বাংলায় দিয়েছেন বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালীন ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন। পরে আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত মামলার রায়ও তিনি বাংলায় দেন। এরও আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক বাংলায় কয়েকটি আদেশ দেন।
আদালতের ভাষা নিয়ে ১৯৯১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশে বলা হয়, আদালতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ব্যবহারের পথে কোনো বাধা নেই। তবে ওই আদেশে ইংরেজির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়নি। কারণ হিসেবে আদেশে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত আইনে আদালতে রাষ্ট্রভাষা ছাড়া অন্য ভাষার প্রচলন রদ করে কোনো বিধান যোগ করা হয়নি। কিন্তু এ আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘এ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদের বিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রণীত।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ভাষা প্রশ্নে ‘রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও জিন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশের আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। অথচ উচ্চ আদালত এখনো ইংরেজির ব্যবহার অব্যাহত রেখেছেন।
বায়ান্নর রেশ ধরে বাংলাকে প্রাণের ভাষা বলেই দাবি করি আমরা। নেই কোনো আইনি বাধাও। তারপরও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিরন্তর বিদেশি ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছি আমরা। অথচ এখানে সব কিছু বাংলায়ই হতে পারে। এর বাস্তবায়নে কেবল আইন দরকার না কি সচেতনতাও, সেটা নির্ধারণ করাটা জরুরি।
সৌজন্য: বাংলানিউজ২৪