সাব্বির আহমদ: ভাষাটি অপ্রচলিত। এ প্রজন্মের কাছেও অজানা। তবে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রম এ কারণে যে, ভাষাটির লিপি আছে, অথচ ভাষাটি হারিয়ে গেছে। সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তার এক বড় উদাহরণ নাগরী ভাষা।
নাগরী ভাষার গবেষক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশ্রাফুল করিম বাংলানিউজকে বলেন, নাগরী আঞ্চলিক ভাষা ও বাংলা ভাষার একটি উপভাষা নয়। একটি স্বতন্ত্র ভাষা। যার লিপি আছে। রয়েছে আলাদা ব্যাকরণ।
বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও রচনা থেকে জানা যায়, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত শাহজালাল (র.) এর সঙ্গে ৩৬০ আউলিয়া সিলেটে আসেন। তারা মূলত বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসেন। তাদের নিজস্ব কোনো ভাষা বাংলা ছিল না। তখন একটি ভাষার চর্চা শুরু হয়, সেটা-ই নাগরী ভাষা হিসেবে পরিচিতি পায়।
ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, ভাষাটি এতই সহজ যে, নারীরা আড়াই দিনে শিখতে পারতেন, আর পুরষদের শিখতে মাত্র একদিন লাগতো।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, নারীরা গৃহস্থালির কাজকর্মের কারণে সময় কম পেতেন, তাই এ ভাষা শিখতে তাদের লাগতো আড়াই দিন। আর পুরুষরা গৃহস্থালির কাজ না থাকায় একদিনেই শিখে নিতেন।
জানা গেছে, এ ভাষার প্রচলন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহুসংখ্যক লোকের মাতৃভাষা নাগরী। এটি একটি প্রাচীন ভাষা।
ভাষাটির উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, ইসলাম প্রচারের জন্য এখানে ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে হযরত শাহজালাল আসার পর ভাষাটি শুরু হয়। তখন হিন্দুরা সংস্কৃত আর মুসলমানরা আরবির প্রতি আসক্ত থাকায় তাদের একই ভাষায় নিয়ে আসতে এই ৩৬০ আউলিয়ার মধ্য থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিলো, যারা হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি লিপি বের করে। উদ্দেশ্য ছিলো সবার মধ্যে ইসলাম প্রচার করা।
তিনি আরও বলেন, ভাষাটি শেখা সহজের কারণে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, নাগরী ভাষার বর্ণমালাগুলো আমাদের সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক গৃহস্থালির দ্রব্যের আকৃতির অনুরূপ হওয়ায় এটি শেখা ছিলো সহজ। একটি বর্ণের সঙ্গে আরেকটি বর্ণের যথেষ্ট মিল ছিলো।
নাগরী ভাষা নিয়ে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত এই লেখক জানান, লন্ডনে সাম্প্রতিককালে ভাষাটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নাগরী ভাষা ইনস্টিটিউট করা হয়েছে।
ড. আশ্রাফুল মনে করেন, ভাষাটি চর্চা ও গবেষণা হলে অনাবিষ্কৃত অনেক পুঁথি উদ্ধার সম্ভব। যার মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন করে বিনির্মাণ হবে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভাষাটির ব্যপ্তি ছিলো আসামের করিমগঞ্জ থেকে সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত। প্রথমদিকে এটি ইসলাম প্রচারের জন্য উদ্ভব ঘটলেও পরবর্তীতে নাগরী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা চলতে থাকে।
এদিকে, বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে আরও জানা গেছে, হালের অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে যেগুলো নাগরী লিপিতে লেখা হয়েছিল। যেমন-সৈয়দ শাহনুরের (১৭৩০-১৮৫৫) ‘অরিন জংগলার মাঝে বানাইলাম ঘর/ভাই নাই, বান্ধব নাই, কে লইব খবর’ কিংবা শিতালং শাহের (১৮০০-১৮৮৯) ‘অজ্ঞান মন, খুয়াইলায় মহাজনের ধন’সহ এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই ভাষা (বর্ণ) সহজে শেখা যেত। সিলেটের নাগরী বর্ণমালায় বর্ণসংখ্যা ৩২টি। বর্ণগুলো হচ্ছে ‘আ ই উ এ ও ক খ গ ঘ চ ছ জ ঝ ট ঠ ড ঢ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম র ল ড় শ হ’।
নাগরী ভাষার আরেক গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক তার ‘সিলেটের নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল’ গ্রন্থে ৩৩টি বর্ণের কথা বলেছেন। এ নাগরী বর্ণমালায় দুষ্প্রাপ্য ১৫টি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনী সংস্থা উৎস প্রকাশন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কেতাব হালতুননবী’, ‘কড়িনামা’, ‘চন্দরমুখী’, ‘সোনাভানের পুঁথি’, ‘মহব্বতনামা’ ইত্যাদি।
অনেকের না জানা এই ভাষা নিয়ে এবারের বই মেলায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশ্রাফুল করিম ‘ভাষার নানারূপ’ নামে একটি বই বের করেছেন।
এতে নাগরী ভাষা ছাড়াও সিলেটের চা শ্রমিকদের ভাষা দেশোয়ালি, সিলেটের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী পাত্র সম্প্রদায়ের ভাষা লালং নিয়ে প্রবন্ধ রয়েছে।
বইটি প্রকাশ করেছে গতিধারা প্রকাশনী। দু’ একদিনের মধ্যে বইমেলায় গতিধারা প্রকাশনীর স্টলেই পাওয়া যাবে বইটি।
এর আগে, নাগরী ভাষা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান পত্রিকা এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্পাদিত ‘সাস্ট জার্নাল’-এ একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।