বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১৫

দক্ষিণ এশিয়া: ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক ভূত

দক্ষিণ এশিয়া: ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক ভূত

কুলদীপ নায়ার |

ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশদের সাম্প্রতিকতম খোঁচাটি এসেছে এক ইতিহাসবিদের কাছ থেকে, যিনি ভগৎ সিং ও চন্দ্রশেখর আজাদকে চিত্রিত করেছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে। দুজনকেই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী ও বিপ্লবীর পার্থক্য বুঝতে ব্রিটিশরা স্পষ্টই অক্ষম। আসলে ব্রিটিশরাই সন্ত্রাসবাদীদের শ্রেণীভুক্ত। কারণ, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করেছে এমন হাজার হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছে। অথচ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, আর ব্রিটিশরা দাবি করে যে গণতন্ত্র তাদের খুব পছন্দ।
ব্রিটিশদের ১৫০ বছর দুঃশাসনের জন্য ভারতবর্ষের মানুষ আজ আর তাদের দুর্নাম করে না। ভারতীয়রা তিক্ত অতীতকে মেনে নিয়েছে, এমনকি ব্রিটেনের রানিকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মেনে কমনওয়েলথেও যোগ দিয়েছে। তবু ব্রিটিশরা কখনো অতীত না ঘাঁটার জন্য ভারতের উদারতা স্বীকার করে একটি কথা বলেনি বা লেখেনি। কিন্তু তারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের হেয় করা অব্যাহত রেখেছে।
এটা আনন্দিত হওয়ার মতোই খবর যে ভগৎ সিং তরুণ বয়সে যে বাড়িতে বাস করতেন, পাকিস্তান সরকার সেটি সংরক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। দেশবিভাগের আগে ব্রিটিশদের দুঃশাসনের শিকার ব্যক্তিরা সবাই পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতে নায়কের মর্যাদায়
আসীন। আমার আকাঙ্ক্ষা, তাঁরা নিজেদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে নিজ নিজ দেশের জনগণকে বলবেন যে তাঁরা একই ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ব্রিটিশদের হাতে একই দুর্ভোগের অংশীদার।
ব্রিটিশ নির্মমতার এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। এটি স্বাধীনতার পথে অগ্রযাত্রায় জাতীয়তাবাদীদের জন্য এক মাইলফলক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারকে অমৃতসরের নিয়ন্ত্রণ দিয়েছিলেন পাঞ্জাবের লে. গভর্নর মাইকেল ও’ ডোইয়ের। ডায়ার ফসল কাটার উৎসব বৈশাখীর দিনটি বেছে নিয়েছিলেন প্রতিশোধের জন্য। রাওলেট অ্যাক্ট নামে এক কালাকানুনের প্রতিবাদ করতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ নামের উদ্যানে। শিকারিরা যেভাবে তাদের হিংস্র কুকুরের পালকে শিকারের পেছনে লেলিয়ে দেয়, ব্রিগেডিয়ার ডায়ার পুলিশকে সেভাবেই ওই সমাবেশের ওপর লেলিয়ে দিয়েছিলেন। কেউ যাতে পালাতে না পারে, সে জন্য তিনি পরিকল্পিতভাবে উদ্যানের একমাত্র ফটকটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গুলির মুখে অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা পালানোর কোনো পথ পায়নি। পুলিশ গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যায়। সেদিন এক হাজার ৬৫০টি গুলি করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে বহু লোক উদ্যানের একমাত্র কূপটিতে লাফিয়ে পড়েছিল, যা ছিল ওই বর্বর হত্যাযজ্ঞের নির্বাক সাক্ষী। সেদিন ঘটনাস্থলেই ৪০০-এর মতো লোক প্রাণ হারায় আর এক হাজার ৫০০-এর বেশি আহত হয়। ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্র লন্ডনও এতে আঁতকে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকার ব্রিগেডিয়ার ডায়ারকে ডেকে পাঠায়। তদন্ত কমিটির সামনে ডায়ারের ব্যাখ্যা ছিল, তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। ডায়ার কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। সরকারের পক্ষ থেকেও তাঁকে তিরস্কার করা হয়নি। ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ তাঁর পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ডায়ার পাঞ্জাবকে ‘অরাজকতা’ থেকে রক্ষা করেছেন।
তার কয়েক বছর পর ব্রিটিশ সরকার ইউপি ও বিহার সীমান্তে অবস্থিত শহর বালিয়াতে কয়েক শ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। স্বাধীনতা ঘোষণা করাই ছিল তাঁদের অপরাধ। মুক্তিসংগ্রামীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য লাশ বেশ কয়েক দিন গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ভারতীয় বিপ্লবীরা এতে দমে যাননি। মহাত্মা গান্ধীকে ‘নৈরাজ্যবাদী’ আখ্যা দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার জন্য তারা যেকোনো কিছু করতে তৈরি ছিল। অন্যদিকে ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা নিজেদের তুলনা করতেন প্রদীপের শিখাটি জ্বালিয়ে রাখতে নিজেদের প্রাণ দেওয়া পতঙ্গের সঙ্গে। তাঁরা যদি শহীদ না হতেন, তাহলে কারাবরণ করা বা জীবন দেওয়া হাজারো স্বাধীনতাকামী অনুপ্রেরণা পেতেন না।
এসব শহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় তাঁদের প্রশংসা করেছেন মহাত্মা গান্ধী, যিনি নীতিগতভাবে বিপ্লবীদের সহিংস পন্থার বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তাঁরা শহীদ হয়েছেন। তাঁদের মৃত্যু দৃশ্যত অনেকের কাছেই ব্যক্তিগত ক্ষতির মতো। আমিও সবার সঙ্গে মিলে এসব তরুণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
মহাত্মা গান্ধী যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয়। একপর্যায়ে যখন মনে হচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার পিছু হটছে, তখনই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন গান্ধী। বাস্তবিকই অসহযোগ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের পরিচালিত সবচেয়ে বড় অহিংস আন্দোলন। তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করায় সবাই প্রতারিত বোধ করেন।
হঠাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পেছনে ছিল উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা গ্রামের বাসিন্দাদের সহিংস হয়ে ওঠার ঘটনা। গান্ধীজি এটা মেনে নিতে পারেননি। ১৯২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোরখপুরের কাছের ওই গ্রামের কিছুসংখ্যক বাসিন্দা স্থানীয় থানার পাশ দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী মিছিল বের করে। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলকারীদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলে তারা খেপে গিয়ে চড়াও হয়। ক্ষুব্ধ পুলিশ জবাবে মিছিলকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গোলাবারুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনায় তিনজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন, কিন্তু পুলিশের নিন্দা করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
ব্রিটিশদের উচিত নয় আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া। ভগৎ সিং ও চন্দ্রশেখর আজাদের মতো বীরদের কালিমালিপ্ত করে তারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। এ থেকে বিরত থাকলেই তারা ভালো করবে।

 

ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025