নীলুফা বেগম। থাকেন সাভারের আমতলা এলাকায়। এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিলো তার। কাজ করতেন রানা প্লাজার ফ্যানটম অ্যাপারেলসে। গত বছরের ২৪ এপ্রিল যেন সব সুখ কেড়ে নিয়েছে নীলুফা’র। সেদিনের পর থেকে স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে গেছে তার। দুঃসহ জীবন থেকে এখন মুক্তি পেতে চান তিনি।
রানা প্লাজা ধসের পর বচল পার হতে চললো। কিন্তু ক্ষতিপূরণের দেখা মেলেনি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও নিহত কর্মীদের স্বজনদের। অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে এসব শ্রমিক পরিবারকে। সামনে যেন কেবলই অন্ধকার।
স্বামীর ছোট একটি দোকানের ওপর ভর দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না নীলুফা। এক মাত্র ছেলে রিফাতের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে হাজারো চিন্তা। তারওপর ডাক্তার বলেছে ডান পা কেটে ফেলেতে হবে। তাতেও প্রয়োজন অনেক টাকা। যেখানে দু’বেলা ছেলের মুখে খাবার যোগাড় করতে পারেন না, সেখানে অপারেশন কেবলই যেন বিলাসিতা নীলুফার জীবনে।
এক সময়ের কর্মব্যস্ত নীলুফা’র দিন কাটে কেবলই হুইল চেয়ারে বসে। যে নীলুফার হাতে তৈরি পোশাক যেতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ সেখানে ঘরের খাবারও তৈরি করতে পারেন না তিনি।
স্বামী শহীদুল ইসলাম বলেন, ওই বিল্ডিং থেকে বাইর করার পর আজ পর্যন্ত তারে আমি হাসতে দেখি নাই। ছোট যে দোকান আছে তাতেও কোনো লাভ হয় না। চিকিৎসা করতে গিয়ে দোকানের সব জিনিসই প্রায় শেষ। কিভাবে দিন কাটাবো জানি না।
আজ পর্যন্ত নীলুফা কেবল ১০ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। টাকার অভাবে নীলুফার চিকিৎসা প্রায় বন্ধের পথে।
অন্যদিকে কর্মক্ষম সন্তান আজমকে হারিয়ে ভিক্ষা বৃত্তিকেই বেছে নিয়েছেন পিতা আবদুর রহমান। সাভার ওভার ব্রিজ এলাকা ও তার আশেপাশেই পাওয়া যায় আবদুর রহমানকে। ছেলে আজম রানা প্লাজার ইথার টেকে কাজ করতেন। অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সকালে গিয়েছিলেন কাজে। তারপর আর শেষ বারের মতো তার মুখও দেখতে পাননি আবদুর রহমান। এক বছরে ক্ষতি পূরণ তো দূরের কথা, ছেলের কোনো খোঁজও পাননি তিনি। এক বছর ধরে খোঁজ মেলেনি আজমের লাশের।
জীবনের গতি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে ফোয়ারার। ফোয়ারার বাবা ইব্রাহিম কাজ করতেন রানা প্লাজায়। দশ বছর বয়সে এখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হয়েছে ফোয়ারাকে। ফুফু সালমার কাছেই আশ্রয় নিয়েছে। আছে ছোট দুই ভাইও। বন্ধ হয়ে গেছে পড়ালেখা। এইটুকুন বয়সে দুই ভাইযের দাযিত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে ফোয়ারাকে। ভবিষ্যতে কী করবে তাও জানে না।
ফুফু সালমা জানান, ফোয়ারার বাবা মারা যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত এক টাকাও সহায়তা পায়নি ফোয়ারা ও তার পরিবার।
অন্যদিকে আহত অনেক শ্রমিকই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। উচু বিল্ডিং দেখলেই এখনো আঁতকে ওঠেন এমাদুল ইসলাম। এমাদুল ইসলামের মতো আরো অনেক শ্রমিক এখন আর কোনো কারখানায় কাজ করতে পারছেন না মানসিক সমস্যার কারণে।
রানা প্লাজা গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি এমাদুল ইসলাম জানান, শুধু বায়ারদের পাঠানো সাহায্যের ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছেন এসব শ্রমিক।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে। নিহত হয় এগার শতাধিক শ্রমিক। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। অনেক নিহত শ্রমিকের পরিচয় জানা আজও সম্ভব হয়নি। সরকার, বিজিএমইএ নানা সাহায্যের আশ্বাস দিলেও এখনো অনেক শ্রমিকই কোনো প্রকারের ক্ষতিপূরণ পায়নি। দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটছে এসব শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের।
ভবনটি ধসে পড়ার সময় পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
১৭ দিন উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর পর ১১শ’ ২৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অসংখ্য মানুষ আহত হন। অনেক মৃত দেহেরই খোঁজ মেলেনি তখন। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অনেকেরই লাশই দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়। আত্মীয়-স্বজনদের আহ্বান জানানো হয় ডিএনএ টেস্ট মিলিয়ে লাশ শানাক্তকরণে সহায়তা করার।
বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযাযী, রানা প্লাজায় কর্মরত ২১২ শ্রমিকের লাশ এর ডিএনএ টেস্ট মেলানো হয়েছে। বাকি আছে আরো ১০৫ জন শ্রমিকের ডিএনএ টেস্ট মেলানো।
তবে নিখোঁজ শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই বিজিএমইএ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কাছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিজিএমএ এর সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজীম বাংলানিউজকে বলেন, ক্ষতিপূরণ মূলত আইএলও ও সরকার করছে। সরকারের তহবিলে অনেকেই সহায়তা দিয়েছে। রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৯০৯ জনকে এক লাখ টাকা থেকে সাত লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া অঙ্গহানি হয়েছে এমন ৩৬ জন শ্রমিকের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ সহায়তা করা হয়েছে।