মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে মান্নাকে বাঁচান অথবা রাজনীতি নয়, মান্নার জীবন বাঁচানোই কঠিন বিপদের দিনে মানুষ যে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, তা গল্প বলে কাউকে বুঝানো যাবে না।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন তার গৌরবোজ্জল অতীত, কর্ম, প্রতিপত্তি কিংবা সামাজিক মর্যাদা কোনো কিছুরই যেন মূল্য থাকে না। সবই যেন অর্থহীন। পৃথিবীটা তার কাছে একেবারেই অমাবস্যার রাতের ন্যায় অন্ধকার হয়ে আসে। খুব কাছের বন্ধু ও আত্মীয়রাও দূরে সরে যেতে থাকে। ক্রমেই সে একাকী হতে থাকে। আর এমনই এক বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন আজ আমাদের সবার প্রিয় মুখ মাহমুদুর রহমান মান্না ও তার পরিবার।
যতদূর জানি তাতে, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না একজন বড় মাপের মানুষ। অনেক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত এই মানুষটির অসংখ্য সমর্থক ও গুণগ্রাহী রয়েছে। এমন কী সরকারী দলের মধ্যেও এখনো তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ও সমর্থক রয়েছে। তাঁর সাথে আমার বেশী দিনের পরিচয় নয়, বয়স ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় তাঁর সাথে আমার সখ্যতা থাকার কথাও নয়।
মূলত: নাগরিক ঐক্য গঠনের পর থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। এছাড়াও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঝে মধ্যে ফোনেও কথা হতো। গ্রেফতারের দুইদিন পর বিবেকের তাড়ণায় পরিবারের খোঁজ নিতে মান্না ভাইয়ের খুব কাছের লোক বলে পরিচিত, ইতোপূর্বে যিনি তার (মান্না) প্রশংসায় সর্বদা পঞ্চমুখ থাকতেন এমন একজনকে ফোন করলাম। কিন্তু এমন ভাব দেখালেন তিনি যেন মান্নাকে একেবারেই চিনেন না।
এরপর্ও প্রবল ইচ্ছায় আরো কয়েকজনকে ফোন করেও তাদের কাছ থেকে মান্নার পরিবারের ফোন নম্বরও না পেয়ে অনেকটা হতাশ হলাম। এমন কী মান্নার খুব কাছের একজন মানুষ আমার ছোটভাই (নাম উল্লেখ করলে হয়তো লজ্জ্বাবোধ করবেন) আমাকে ঝামেলামুক্ত থাকতে এ বিষয়ে কিছু লিখতেও মানা করে পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ মান্নার সুসময়ে বন্ধুর অভাব ছিল না, আজ বিপদের দিনে আমরা কেউ তার পাশে নেই। পরে
পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে যতদূর জানতে পেরেছি তাতে- কিছুদিন আগেও যারা মান্নার বাসায় প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতেন এমন ব্যক্তিরা গ্রেফতারের পর বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা ফোন দিয়েও অসুস্থ মান্নার একবার্ও খোঁজ নেননি। কী নিষ্ঠুর পৃথিবী!
মান্না ভাই বলেই সম্বোধন করতাম, তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো করে স্নেহ করতেন। গেল বছরের শেষের দিকে এক অনুষ্ঠান শেষে প্রেসক্লাবে বসে সিনিয়র কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন আমিও সেখানে ছিলাম। খোলামেলা গল্প করতে গিয়ে একসময় রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠে আসলে মান্না ভাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতি কতটা বিচিত্র তা আমার চেয়ে বেশী কেউ জানেন না। এক সময় নেত্রী আমাকে এতটাই বিশ্বাস ও ভালবাসতেন যে, একদিন যোগাযোগ না হলেই তিনি আমাকে ডেকে পাঠাতেন। আমাদের মধ্যে সখ্যতা এতটাই ছিল যে, পারিবারিক বিষয়ও আমরা একে অপরের সাথে শেয়ার করতাম।
আর এ কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বিষয়েই নেত্রী আমার উপর নির্ভর করতেন। আর এ স্নেহ-ভালবাসা থেকেই অনেকে আমাকে নেত্রীর ঘনিষ্টজন হিসেবে জানতেন।’
এছাড়া্ও যতদূর জানি তাতে, সাংগঠিক বিশেষ দক্ষতার কারণে এক সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে স্নেহ করার পাশাপাশি দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বও দিতেন। আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকও করেছিলেন তাকে। মাহমুদুর রহমান মান্না ও তার পরিবারের কাছে আজ এ সব কিছুই যেন অতীত স্মৃতি। থাক এসব বিষয়, ফিরে আসি বর্তমান মান্নার কথায়। অতীতের দাপটের নেতা মান্নার রাজনৈতিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে মূলত: ১/১১ পর থেকে। এই সময় তিনি দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও দলের নেতানেত্রীদের বিষয়ে বেশ কিছু সত্য অথচ তিক্ত কথা বলেন। আর এ কারণেই রাতারাতি তিনি দলে সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। আর এ সুযোগে নেত্রীর কান ভারী করেন তারই এক সময়ের কিছু সহকর্মী। এরফলে ধীরে ধীরে সরে যান নেত্রীর স্নেহ-ভালবাসা থেকে, ছিটকে পড়েন দলের নীতিনির্ধারক টেবিল থেকে।
এরপর যা হবার তাই হলো। পরে মান্না অনেকটা হতাশা-ক্ষোভ থেকেই গঠন করেন নাগরিক ঐক্য নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন টকশোতেও বেশ সক্রিয় ছিলেন। এরপর থেকেই মূলত: দলের দূরত্ব আরো প্রকট হয়। তবে মান্না ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তায় যা মনে হয়েছে তাতে- তিনি কখনোই আওয়ামী লীগ কিংবা ওই দলের নেতানেত্রীর কোনো অমঙ্গল কামনা করতেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে তার মুখে নেত্রীসহ অনেক নেতার প্রশংসাই শোনা গেছে। এছাড়া তিনি এমনটিও কখনো চিন্তা করেননি
যে- একদিন তাকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে! বরং তাঁর মাঝে এমন একটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে- সরকার যাই করুক, কখনো তাকে কোনো ধরনের হয়রানি করবে না। তাঁর বিশ্বাস যাই থাক না কেন, আমাদের দেশের প্রতিহিংসার রাজনীতি বলে কথা। এর ফলে যা ঘটার তাই ঘটলো। মান্না জেলে গেল, রিমান্ডে থেকে হাসপাতালে। জানি না, এরপর তাঁর ভাগ্যে কী লিখা আছে!
নিখোঁজের ২০ ঘণ্টা পর নানা নাটকীয়তায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ভাইকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে তাকে গুলশান থানায় করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর তাকে দুই দফা ২০ দিনের রিমান্ডে নেয়া পুলিশ তাকে রিমান্ডে কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং তার সাথে কী ধরনের আচরণ করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে সুস্থ মান্নাকে গ্রেফতার, এরপর রিমান্ডে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আদালতে হাজির এবং পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অতপর সংবাদ সম্মেলনে মান্নাকে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তার পরিবারের সদস্যরা। গত কিছুদিন থেকেই মিডিয়ায় মাহমুদুর রহমান মান্নার শারীরিক অবস্থার খবরে খুবই খারাপ লাগছিল। আজ সংবাদপত্র পাঠে মনটা আরো বেশী খারাপ হয়েছে। কেননা, সংবাদপত্র পাঠে যা জানতে পেলাম তাতে মান্নার অবস্থা এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমরা যখন নববর্ষ উদযাপন ও আনন্দ স্ফুর্তি নিয়ে ব্যস্ত তখন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের এই নেতা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) কঠোর পাহারায় চিকিৎসাধীন।
মান্নার পরিবারিক সদস্যদের ভাষ্যমতে, তাঁর বুকের ব্যথার পাশাপাশি মেরুদণ্ডে ব্যথা, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপসহ বেশ কয়েকটি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় চোখে স্প্রিন্টার লাগায় তাকে লেন্স ব্যবহার করতে হয়। ১৫ দিন পরপর মেরুদন্ডের ব্যথার থেরাপি দিতে হয়। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর থেকে তা আর দেয়া হচ্ছে না। এতে ক্রমান্বয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তিনি। শারীরিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।
চিকিৎসকরাও জানিয়েছেন, মান্নার শারিরীক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি নেই। এদিকে বর্তমানে গুরুতর হৃদরোগী হিসেবে যে ধরণের চিকিৎসা ও পথ্য দরকার সেসবের বেশিরভাগ থেকে তিনি বঞ্চিত। বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. এমজি আজমের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডের অধীনে। মঙ্গলবার রাতেও তার বুকে ব্যাথা হয়। প্রথম ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার পর অসুস্থ্ অবস্থায় মান্নাকে প্রথমে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে। সেসময় তার হৃদপিন্ডের প্রধান শিরায় তিনটি ব্লক সনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু প্রধান শিরায় রিং বসানো সম্ভব নয় বলে চিকিৎসকরা তা থেকে বিরত থেকেছিলেন।
এরপর গত দুইদিনে মিডিয়ার কল্যাণে যা জানতে পেরেছি তাতে, কারাবন্দি মান্না ফের অসুস্থতা অনুভব করলে প্রথমে বারডেম হাসপাতাল ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) শয্যা ফাঁকা না থাকায় ওই দুই হাসপাতালে তাকে ভর্তি করতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর তাকে গত মঙ্গলবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
তবে মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার শুরু থেকেই সুচিকিৎসা যাতে নিশ্চিত করা হয়। দাবি করে আসছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পহেলা বৈশাখের দিন আমরা সবাই কতই না আনন্দ উল্লাস করেছি তাই না! কিন্তু তার ভাগ্যে নূন্যতম একটি বৈশাখী পোশাকও জোটেনি। পান্তা ইলিশ তো দূরের কথা স্বাভাবিক খাবারও জোটেনি। আর এই প্রভাবে মান্নার পরিবারেও ছিল না বৈশাখী আমেজ। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে তার স্ত্রী, দুই সন্তানদের কেউ বৈশাখী রাঙা পোশাকে আবৃত হ্ওয়া তো দূরের কথা বৈশাখী খাবারের স্বাদও গ্রহণ করেননি তারা। ঘুরতে যাননি কোথাও।
হ্যাঁ তারা ঘুরেছেন, সেটা কোথায়? আমরা কয়জন সেটার খবর রেখেছি। মান্নার অতিঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নাগরিক ঐক্যের নেতা আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে যা জানলাম তাতে, পহেলা বৈশাখের দিন মান্না ভাইয়ের স্ত্রী মেহের নিগার ও তাদের সন্তানেরা হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরাফেরা করেছেন। তবে কড়া প্রহারার কারণে মান্নার পাশে যেতে পারেননি তারা। আরো অনেক আত্মীয় স্বজন্ও তাকে দেখতে এসেছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু সাক্ষাৎ পাননি মান্নার। কী নির্মমতা!
এর চেয়েও বেশী কষ্ট পেয়েছি, যখন দেখেছি মান্না ভাইয়ের স্ত্রী ও সন্তাদের ডিবি অফিস, থানা, কারাগার ও আদালত পাড়ায় বিমর্ষভাবে ঘুরাফেরা করতে। দেখেছি মান্নার কিশোরী মেয়েটিকে আদালতপাড়ায় মাটিতে লুটিয়ে বাবার জন্য অঝরে কাঁদতে। দেখেছি সংবাদ সম্মেলনে আহাজারি করতে। জানিনা, আর কত দিন আমাদের এই পরিবারটির আহাজারি দেখতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, তিনি অপরাধ করে থাকলে আইনী প্রক্রিয়ায় তার বিচার হবে সে ব্যাপারে আমাদের কোনো কথা নেই।
তবে বিচারের আগেই বিচার, এটা কোনোভাবে কারো কাম্য নয়। ফলে এ নিয়ে কোনো রাজনীতি নয়, এখন মান্নার জীবন রক্ষা করাই জরুরী বিষয়। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান রাখতে চাই, মাহমুদুর রহমান মান্না তো এক সময় আপনার খুব স্নেহের মানুষ ছিলেন। মানুষ মাত্রই ভুল হতেই পারে। ফলে তিনি যদি কোনো ভুল করেই থাকেন তবে আপনি তো ইচ্ছা করলেই পারেন তাকে ডেকে নিয়ে বুঝাতে, প্রয়োজনে শাসাতে। পারেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে নিতে। সবশেষে আমার বিনীত অনুরোধ- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হাতে অনেক ক্ষমতা।
ইচ্ছা করলেই আপনি অনেক কিছু করতে পারেন। দয়া করে, মাহমুদুর রহমান মান্নার জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে আপনি এব্যাপারে একটু হস্তক্ষেপ করুন। সেই সাথে মান্নাকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে জীবন রক্ষায় সুচিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিন। অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনা থেকে পরিবারটিকে রক্ষা করুণ।
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক, ই-মেইল: sarderanis@gmail.com