ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম: চাঁদ দেখা সাপেক্ষে পবিত্র রজানুল মোবারক শুরু হতে পারে আগামী শুক্রবার অর্থাৎ ১৯ জুন থেকে। রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতিবছর মু’মীনদের জন্য মাহে রমযান উপস্থিত হয়। মাহে রমযান মু’মীন জীবনে সৌভাগ্যের সুসংবাদ নিয়ে আসে।
আত্মশুদ্ধি আর মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ অর্জনের অসীম রহমতের এই মাস। আল্লাহ্ তায়ালার বরকত ও করুণা ধারায় আমাদের জীবনকে সিক্ত করতে পবিত্র মাহে রমজান ফিরে এলো আরেকবার। রমজানের প্রতিটি দিনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অগণিত বান্দা প্রভুর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং বৈধ আকাক্সা পরিত্যাগ করে স্যা দেয় যে, শুধু আল্লাহ তায়ালাই তাদের প্রভু আর একমাত্র তার সন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি।
ধর্মভীরু মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মাহে রমজানের রোজার ভূমিকা অপরিসীম। রোজাদার ব্যক্তি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ভয়ে পাপাচার, অশ্লীলতা, মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহসহ সব ধরনের মন্দ কাজ পরিহার করে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন।
রোজা অবস্থায় কেউ যদি রোজাদার ব্যক্তিকে গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ, অশুভ ও ক্ষতিকর দুষ্কর্মে প্ররোচিত করে, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী তিনি যেন বলে দেন, আমি রোজাদার। মাহে রমযান সংযমের নৈতিক উৎকর্ষতা ও ঈমানী চেতনা বৃদ্ধির শ্রেষ্ঠ সময়। মাহে রামাদ্বানে আল্লাহ তায়ালা রোযা রাখা ফরজ করেছেন। রোযা আমাদের মাঝে ধৈর্য্য, সংযম, সহমর্মিতা ও তাক্বওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি করে। যা ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির চাবিকাঠি।
এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে এত বেশি বরকত লুকিয়ে আছে যে, এই মাসে আদায় করা নফল কাজগুলো ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো ৭০ গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি। রমজান মাস এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, সৎ পথে চলার পথ সহজ হয়ে যায়, শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয় (বুখারি ও মুসলিম)। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে রোজা ঢালস্বরূপ।
অতএব, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা একিন ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে রাখবে তার অতীত ও বর্তমানের সব গুনাহ মা করে দেয়া হবে (বুখারি)। কদরের রাতে যে ব্যক্তি কিয়ামের মাধ্যমে রাত কাটিয়ে দেবে তাদেরকেও মা করে দেয়া হবে শুধু এই শর্তে যে, আল্লাহ্ তায়ালার বাণী আর ওয়াদাকে তারা সত্য মনে করবে, বান্দা হিসেবে নিজের সব দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করবে’ (বুখারি)।
ব্যক্তিগত জীবনে রোজাদার তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। নৈতিক পরিশুদ্ধি ও আত্মগঠনের মাস হিসেবে মাহে রমজানে রোজাদার মুসল্লি ঘরে-বাইরে নামাজ ও রোজার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা, টুপি কেনেন অথবা ধুয়ে-মুছে পাক-পবিত্র করে রাখেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদন করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ রমজান মাসের বিশেষ খতমে তারাবির নামাজ জামাতে আদায়ের জন্য মসজিদে ছুটে যান। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-ইস্তেগফার, দান-সাদকা করে তারা বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
মুত্তাকিদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অর্থসংকটে দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটের সময় ধৈর্যধারণকারী তারাই হলো সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭৭)
রোজাদার ব্যক্তি রোজা অবস্থায় কখনো মিথ্যা কথা, পাপকাজ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, জবরদখল, সন্ত্রাস, বোমাবাজি প্রভৃতি সামাজিক অনাচারসহ সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, ধূমপান, মাদকদ্রব্য ও জুয়াখেলা—এসব অনৈতিক ও অপকর্মে লিপ্ত হন না। রোজা রেখে কোনো কিছু খাওয়া বা কোনো ধরনের বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ কাজকর্ম করা যাবে না। কারণ, অন্য কেউ না দেখলেও আল্লাহ মানুষের সব কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এখানেই রোজার সঙ্গে অন্যান্য ইবাদতের পার্থক্য রয়েছে।
রোজা এমন একটি ইবাদত, যাতে রিয়া বা লোক দেখানোর কোনো অবকাশ নেই। রোজাদার ব্যক্তি যদি লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো কিছু পানাহার করেন বা কোনো পাপকাজে লিপ্ত হন, তাহলে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত রোজাদার মুত্তাকি ব্যক্তি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য প্রভৃতি ষড়িরপু দমনপূর্বক কঠোরভাবে সিয়াম সাধনা করে থাকেন। তাই আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তিকে বিশেষভাবে পুরস্কার প্রদান করবেন বলে ঘোষণা করেছেন, ‘রোজা শুধু আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
পারিবারিক জীবনে মাহে রমজানের রোজার গুরুত্ব ও অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি—সবাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। রোজাদার ব্যক্তি পরিবারের ছোট-বড় কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন না, সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। মাহে রমজানে রোজা রেখে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যদি অসদাচরণ করা হয় এবং তাদের প্রতি কটুবাক্য, জুলুম, নির্যাতন, গালিগালাজ করা হয়, তাহলে রোজাদারদের পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ লেগে থাকতে পারে। এতে পরিবারে যেমন অশান্তি দেখা দিতে পারে, তেমনি আল্লাহ তাআলাও অসন্তুষ্ট হন।
রমজান মাসে পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে সেহির খাওয়ার পরম আনন্দ রোজার অনন্য বৈশিষ্ট্য। মাহে রমজানে পাড়া-মহল্লায় গভীর রাতে যখন সেহির খাওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ লোকেরা সপরিবারে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, তখন মুসলমানরা পরস্পর সমাজের সমমানের রোজাদার গোষ্ঠী বলে ভাবতে সুযোগ পান। ভোরের স্নিগ্ধতার নির্জন পরিবেশে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের ছোট-বড় সব রোজাদার ব্যক্তির জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাওয়ার অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় এই রমজানুল মোবারকে।
সমাজের শ্রমজীবী খেটে খাওয়া গরিব সম্বলহারা মানুষ যাতে মাহে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য ধনী-সামর্থ্যবান রোজাদারেরা যেন দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন। মালিকেরা যেন শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, অগ্রিম বেতন-ভাতা প্রদান ও কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেন। ধর্মপ্রাণ সৎ ব্যবসায়ীরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে যেন অধিক মুনাফা লাভের আশা বর্জন করেন। এভাবে রোজাদার ব্যক্তি সমাজকল্যাণ, মানবসেবা ও আপামর জনসাধারণের উপকারে আত্মনিয়োগ করলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং পরিণামে তিনি প্রতিশ্রুত জান্নাত লাভ করবেন।
মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রোজার সংযমী মনোভাবের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পক্ষান্তরে রোজাদার ব্যক্তির অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন ও অসদাচরণে যদি সমাজের লোকেরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, তাহলে কেউ তাকে পছন্দ না করে ঘৃণা করবেন। মাহে রমজান পবিত্র ও পরিশুদ্ধ জীবন-যাপনের মাস হলেও অনেকে বিভিন্ন কাজেকর্মে, চলাফেরায় সেই পরিশুদ্ধতার শিক্ষা নিতে পারে না, অন্যান্য সময়ের মতো এ মাসেও ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, কর্তব্যে অবহেলা ও শরিয়ত-গর্হিত অন্যায় কাজে মশগুল থাকে। আল্লাহ তাআলা এহেন তাকওয়াবিহীন দুষ্ট রোজাদার লোকের ওপর খুবই নাখোশ থাকেন। সিয়াম সাধনার সুমহান শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জীবনবোধ যদি রোজাদারদের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়, তাহলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে পারে না।
সুতরাং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে মাহে রমজানের রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাকওয়া অবলম্বনকারী রোজাদার ব্যক্তি যদি জীবনে কোনো প্রকার অন্যায় ও খারাপ কাজ না করেন, কাউকে ঠকিয়ে বা প্রতারণা করে ক্ষতিগ্রস্ত না করেন, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল না মেশান, ওজনে কম না দেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করেন, কারও ক্ষতিসাধন না করেন; বরং সর্বদা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পরোপকার করে মাহে রমজানে ত্যাগের শিক্ষা ও ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনা করেন, তাহলেই মানবজীবনে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
আমরা যারা বছরের পর বছর মাহে রমজান পালন করি এবং রমজান নিয়ে আনেক আলোচনা শুনি রমজান শেষে আমাদের আসলেই কি কোন পরিবর্তন আসে? নাকি ঠিক একই নিয়মে চলতে থাকে নামায কাজ্বা? আমরা কি মুক্ত হতে পারি হারাম কাজ গুলো থেকে? আমরা কি ডাকতে পারি কোন ভাই কে আল্লাহর পথে? কি ক্রমাগত ভুল না আমরা করে চলেছি। আমরা ভুল করেছি এবং নিজেদের ভুল JUSTIFY করতে গিয়ে অন্য ভাইয়ের ভুল খুজতে গিয়েছি, গীবত করেছি এবং নিজের রুহের প্রতি জুলুম করেছি।
মুমিন-মুত্তাকি বান্দারা এ মাসটির অপেক্ষায় অধির আগ্রহে দিন গুনতে থাকে। তারা শুধু ভাবে কবে থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। রমজান মাসের জন্য আগে থেকেই তারা নিজেকে প্রস্তুতও করে তোলে। তারা একটি রুটিন তৈরি করে পূর্বের রমজান থেকে এবারের রমজানে কি কি নেক আমল বেশি করবে। গত রমজানে যদি একবার পবিত্র কোরআন খতম দিয়ে থাকে তাহলে এবার ইচ্ছা রাখে দু’বার দেওয়ার। অর্থাৎ সব কিছুতেই মুমিন চায় পূর্বের তুলনায় বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতে। তাই একজন মোমেন রমজান আসার পূর্বেই নিজেকে রমজানের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। বাহ্যিকভাবে আমরা যেমন স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য অনেক পূর্ব থেকেই নিজেকে গড়ে তুলি আর সবসময় মাথায় পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের চিন্তা ঘুরপাক করে ঠিক তেমনি যারা মুমিন তারা রমজানকে শ্বাগত জানানোর জন্য অনেক পূর্ব থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। রমজানের দিনগুলো কীভাবে কাটাবে তা তারা আগে থেকেই ঠিক করে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করতে থাকে। যার ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া কবুল করেন এবং তাদের সুস্থ রেখে রমজানের ইবাদত করতে সাহায্য করেন।
আমরাও যদি এখন থেকে পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতি নিতে থাকি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শুরু করি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সুস্থ রাখ আমি যেন আগত রমজানে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত, কোরআন পাঠসহ সব পুণ্য কর্ম বেশি বেশি করতে পারি। রমজানের বরকত সম্পর্কে হাদিসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা পরিপূর্ণ ইমানের সঙ্গে এবং নিজের গুনাহ ক্ষমার জন্য আদায় করে তাহলে তাকে বিগত বছরের পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যদি তোমরা জানতে যে, রমজানের কি কি ফজিলত রয়েছে তাহলে তোমরা অবশ্যই এ বিষয়ে ইচ্ছা পোষণ করতে যে, সারা বছরই যেন রোজা হয়।’ (আল জামেউল সাহি মুসনাদ, কিতাবুল সওম)।
তাই আমাদের এখনই রমজানের কল্যাণ থেকে কল্যাণম-িত হওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আর না হয় রমজান চলে আসবে আর মনে মনে ভাবব, হায়! রমজান মাস চলে এলো আর আমি এর জন্য তৈরিই হইনি। শুধু রোজা রাখলেই কি রমজান মাসের সার্থকতা? রোজাও রাখতে হবে এবং বেশি বেশি নফল ইবাদতও করতে হবে। আমরা যদি এখন থেকে রমজানের প্রস্তুতি না নিই তাহলে দেখা যাবে আমরা তারাবির নামাজে অংশ নিতে পারছি না নানা ব্যস্ততার কারণে, ঠিক মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা জামাতে আদায় করতে পারছি না, রাতে দেরিতে ঘুমানোর জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে পারছি না, এছাড়াও আরও অনেক নেক কর্মে অংশ নিতে পারছি না। আর এভাবে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে রমজান মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। পরে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই এখন থেকেই যদি সবাই চিন্তা করে রাখেন, আমি আমার অফিসের কাজ এভাবে এতটার মধ্যে গুছিয়ে নেব যেন আমি তারাবির নামাজে অংশ নিতে পারি। যারা ব্যবসা করেন তারাও ঠিক করে নিতে পারেন এতটা থেকে আমাকে মসজিদে অবস্থান করতেই হবে। যারা ছাত্র রয়েছেন তারাও এখন যদি পড়ালেখা কিছুটা বেশি করেন তাহলে রমজানের ইবাদতে সুবিধা হবে। এভাবে আমরা যে যেই স্থানেই আছি না কেন আমরা যদি এখন থেকেই নিজেকে রমজানের জন্য প্রস্তুত করে তুলি তাহলে আমরা দেখব রমজানের রাতগুলো কত সুন্দর ইবাদতে কাটে।
পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন ‘রমজান সেই মাস যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন যা মানবজাতির জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং হেদায়াত ও ফুরকান (হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী) বিষয়ক সুস্পষ্ট প্রমাণাদি। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এই মাসকে পায়, সে যেন এতে রোজা রাখে, কিন্তু যে কেউ রুগ্ন এবং সফরে থাকে তাহলে অন্য দিন গণনা পূর্ণ করতে হবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না এবং যেন তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তন কর, এ জন্য যে, তিনি তোমাদের হেদায়াত দিয়েছেন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৪)। এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, তিনি আমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান আমাদের জন্য কাঠিন্য চান না। আল্লাহ জানেন রমজান আমাদের জন্য কোনো কষ্টের কারণ নয় বরং আনন্দের। কিন্তু আমরা যারা দুর্বল তারা মনে করি রমজান মাস কষ্টের মাস। আসলে এটা যারা ভাবে তারা অনেক বড় ভুল করে থাকেন। আল্লাহ আমাদের জন্য কাঠিন্য চান না।
এছাড়া হজরত রাসূলে করিম (সা.) রমজানের পূর্বে শাবান মাসে অনেক বেশি ইবাদত করতেন আর তিনি (সা.) রমজান ছাড়াও প্রতি মাসে নফল রোজা রাখতেন আমরাও যদি তাঁর সুন্নত অনুযায়ী প্রতি মাসে কয়েকটি করে নফল রোজা রাখতাম তাহলে আর রমজানের রোজা কোনো কষ্ট মনে হতো না। এছাড়া আমরা যদি মনের সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রমজানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হই তাহলেও রমজানের রোজা কোনো কষ্টই মনে হবে না। যেহেতু আর মাত্র কয়টি দিন বাকি রয়েছে পবিত্র মাহে রমজানের তাই এখন থেকেই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে রমজানের জন্য প্রস্তুত করে গড়ে তুলুন।
আমদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, এই রমজানে আমরা সত্যিকারের তাক্বওয়া অর্জন করতে পরিকল্পিত উপায়ে চেষ্টা করব। নতুবা প্রতি বারের মত এবারো রমজান শেষে নিজেদের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখবনা।
রমজানের আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,” হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।”(বাকারা-১৮৩)
রাসুল(সাঃ) বলেন,” যে ব্যাক্তি ঈমান ও এহতেসাব এর সাথে রোজা রাখবে তার আগের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ঈমানের এর মানে আমরা সবাই জানি- ঈমান হচ্ছে “আল্লাহ একমাত্র প্রভু, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী” এটা আন্তরে বিশ্বাস,মুখে স্বীকার করা ও কাজে প্রমান করা। ঈমানের মুল দাবী হচ্ছে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো দাসত্ব করা যাবে না। এমনকি নিজের নফসের গোলামিও ঈমান পরিপন্থি।কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত নফসের গোলাম হয়ে গুনাহ এর কাজে লিপ্ত। এ থেকে বুঝা যায় আমাদের অবস্থান আসলে কোথায়। এ নিয়ে আমাদের হতাশ হয়ে থাকলে চলবেনা। আল্লাহ বলেন,”আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা।” রমজান আমাদের জন্য সেই রহমত। এই রমজানে আল্লাহ শয়তান কে বন্দী করেন। এই মাসে শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রনা দিতে পারেনা। এবং এটাই আমাদের জন্য সুযোগ। এই সুযোগে নফসের গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার Training আমরা নিতে পারি। এই জন্য “এহতেসাব” অতি গুরুত্বপুর্ন। “এহতেসাব” হচ্ছে নিজের ভুল স্বীকার করে নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পন করা, মাফ চাওয়া, একই ভুল যাতে আর না হয় সে জন্য যা যা করা দরকার তা পরিকল্পিত ভাবে করা এবং এই জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।
রমজান মানুষকে নফসের তিন ধরনের চাহিদা থেকে মুক্ত থাকার Training দেয়ঃ
১- ক্ষুধা ও পিপাসা
২- বিশ্রাম অভিলাস ও বিপথগামী বিনোদন
রমজানে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দিনের বেলা(সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত) না খেয়ে থাকে। আমরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খাইনা শুধু আল্লাহ কে ভয় করে, বৈধ স্ত্রীর সাথে দিনের বেলা ঘনিষ্ট হইনা শুধু আল্লাহ কে ভয় করে, তারাবিহ, ফরজ ও নফল নামায আদায় করি অথচ রমজানের পর সে আমরাই বেশী খাওয়ার জন্যে আন্যের হক নষ্ট করি, অন্য কে বঞ্চিত করি, যৌন লালসার তাড়নায় যেনা ব্যাভিচার ও বিভিন্ন গুনাহ এ লিপ্ত হই, বিশ্রাম অভিলাসে নামজে অনিয়মিত হই। দিনের পর দিন নামাজ কাজ্বা করি, বিপথগামী বিনোদনে মগ্ন হয়ে পড়ি ।
শুধু মাত্র উদ্দেশ্যহীন ভাবে রোযা রাখার কারনে আমরা রমজান থেকে নফসের এই তিন ধরনের চাহিদা থেকে মুক্ত থাকার Training নিতে ব্যার্থ হই।
একটি হাদিসে রাসুল(সাঃ)বলেন, “ অনেক রোযাদার এমন আছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া যার ভাগ্যে অন্য কিছু জোটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদত কারী অনেক মানুষও এমন আছে, যারা রাত্রি জাগরন ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।”
আমরা যদি তাকওয়া অর্জনের জন্য পরিকল্পিত ভাবে ইবাদত করতে পারি তাহলে আমরা অবশ্যই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
আমরা আমাদের পরিকল্পনায় যা যা রাখতে পারিঃ
১- আল-কোরআন সহিহ করার ব্যাবস্থা নেয়া কমপক্ষে নামযে বেশী পঠিত সূরা গুলো ও নামযের তাসবিহগুলো সহিহ করা ।
২- অর্থ সহ আল-কোরআন যতটুকু সম্ভম অধ্যয়ন করা।
৩- নিয়মিত কিছু কিছু হাদিস অধ্যয়ন করা।
৪- বেশী বেশী নফল ইবাদত করা যেমন- প্রত্যেক দিন সেহেরির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার অভ্যাস করা(কমপক্ষে ২ রাকাত হলেও), নামাজ পড়ার জন্য অজু করলে তাহ্যিয়াতুল অজু, মাসজিদে গেলে দুখুলুল মাসজিদ ইত্যাদি।আমাদের দেশে তাহ্যিয়াতুল অজু, দুখুলুল মাসজিদ এগুলোর প্রচলন না থাকলেও এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ন। রাসুল(সাঃ)এগুলো প্রায় সব সময় আদায় করতেন।
৫- ইসলামের গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলির মধ্যে কমপক্ষে যে কোন একটি বিষয় বিস্তারিত অধ্যয়ন করা যেমন- ইসলামে হালাল হারামের বিধান, অর্থনীতি, নারীর অধিকার ইত্যাদি।
৬- দিনে অন্তত একজন ভাইকে নামাজের দাওয়াত দেয়া।
৭- সচেতন মনে কারো গীবত না করা। গীবত সব সময়ের জন্য জঘন্য আপরাধ। একবার দুই আরব মহিলা রোযায় ক্লান্ত হয়ে আল্লাহর রাসুল(সাঃ) এর কাছে বার্তাবাহক পাঠালো জানার জন্যে যে, তারা ক্লান্ত আর পারছেনা এই অবস্থায় তারা কি কিছু খেতে পারবে কি না? রাসুল(সাঃ) বার্তাবাহকের কাছে দু টা পাত্র পাঠালেন আর ওই দুই মহিলাকে বমি করতে বললেন।বমি করার পর দেখা গেল শুধু রক্ত আর মাংস।আল্লাহর রাসুল(সাঃ) কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন তোমরা সারাদিন রোযা রেখে যাদের গীবত করেছ এগুলো তাদের মাংস। গীবত এতটাই জঘন্য।রমজানে গীবত থেকে মুক্ত থাকার এই training আমাদের বাকী সময়টাতেও গীবত থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করবে।
ইসলামী অনুশাসনগুলো ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠার মধ্যেই সিয়াম সাধনার পূর্ণতা। রজনীভাগকে আল্লাহতায়ালা ঘুমের জন্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু জীবনের কোন কোন অংশে এ ঘুম আরাম আয়েশের চেয়েও আল্লাহতায়ালার করুণাপ্রাপ্তির জন্য সময়দানকেই মহানবী (স.) ও তাঁর পুণ্যাত্মা সাহাবায়ে কেরাম, পরবর্তী বুজুর্গানে দ্বীনের কাছ থেকে মহানুভব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মুমিন জীবনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের সোপান বলে আমরা বুঝতে শিখেছি। সে অনুশীলন হচ্ছে আমাদের এ মাসের তারাবীহ্র নামাজ, তাহাজ্জুদের নামাজ ও সেহরি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আজ পবিত্র তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কে কিছু কথা। তাহাজ্জুদ হচ্ছে রূহ ও আত্মার শক্তি সঞ্চয়ের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম। ঝিমিয়েপড়া হৃদয়কে উষ্ণ সজীব রাখার এক শ্রেষ্ঠতম উপায়। এ জন্যই আল কোরানে, আল্লাহপাক মুসলমানদের বারংবার তাকিদ করেছেন তাহাজ্জুদ তথা ‘কেয়ামুল্লায়ল’ সম্পর্কে।
কেয়ামুল্লায়লে (ঘুম থেকে উঠে সুখশয্যা ত্যাগ করে আল্লাহর দরবারে নামাজে দাঁড়ানো) অভ্যস্ত পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদের এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আল্লাহ পাক করেছেন যেন এর মর্যাদা ও গুরুত্ব ফরজের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। পেয়ারা নবী হযরত মুহম্মদ (স.) ঘরে সফরে সর্বদা অত্যন্ত পাবন্দির সঙ্গে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। এমনকি কর্মক্লান্তি ও ঘুমের প্রচ- চাপের কারণে কখনও তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে দিনে তিনি তা আদায় করে নিতেন। ফলে বহুসংখ্যক আলিম এ মত প্রকাশ করেছেন যে, সম্ভবত তাহাজ্জুদ নামাজ তাঁর ওপর ফরজ ছিল।
আল কোরানে আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে (স.) সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন: ‘হে বস্ত্রাবৃত! রাতে (নামাজে) দাঁড়িয়ে থাকুন। হাঁ রাতের কিয়দংশ ব্যতীত। অর্থাৎ অর্ধরাত্রি কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করুন। কুরআন খুব স্পষ্টরূপে তিলাওয়াত করুন। আমি অচিরেই আপনার ওপর এ গুরুভার বাণী অর্পণ করছি’। (সূরা মুয্যামমিল)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘এবং রাতের কিছু অংশেও আপনি তাহাজ্জুদ পড়ুন যা আপনার জন্য অতিরিক্ত। অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে ‘মাকামে মাহমুদে’ স্থান দেবেন।” – (সূরা বনী ঈসরাঈল: ৭৯)।
তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি হযরত (স.) এর আত্মনিমগ্নতা এ কথাই প্রমাণ করে যে, এর বিশেষ আমলটির প্রতি তাঁর পবিত্র হৃদয়ে ছিল অপরিসীম প্রেম ও সুগভীর অনুরাগ। তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি এমনই আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়তেন এবং এত দীর্ঘ কিয়াম ও রুকু করতেন যে, তাঁর কদম মুবারক ফুলে উঠত।
বুখারী ও মুসলিম শরিফে হযরত মুগীরা বিন শু’বা (রাদি.) বর্ণনা করেছেন : একবার রাসূলে কারিম (স.) এত দীর্ঘ কিয়াম করলেন যে, তাঁর কদম মুবারক ফুলে গেল। আরজ করা হয়, হে আল্লাহর রাসূল (স.) আল্লাহ তো আপনার অগ্রÑপশ্চাদ গোনাহ (যদি তা থেকে থাকে) ক্ষমা করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করলেন, তাই বলে কি আমি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?)
পুণ্যাত্মা সাহাবা কিরামের জীবন চরিত্র, সিরাত ইতিহাস ও হাদীস সম্ভার পর্যালোচনাকারী যে কোন ব্যক্তি খুব সহজেই এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, যুগে যুগে সর্বত্র তাহাজ্জুদের আমল জারি ছিল। বরং তাহাজ্জুদ তথা কেয়ামুল্লায়লই ছিল পুণ্যাত্মা সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ান (রাদি.) এর বৈশিষ্ট্য। সাহাবাদের বিষয়ে হযরত ইমাম হাসান বসরীর চেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে আর কে জানতে পারেন? পরবর্তীদের জন্য তিনি সাহাবা কিরামের পুণ্য চিত্র একে গিয়েছেন এভাবে : “সত্যের ডাক তাদের কানে পৌঁছা মাত্র তাঁরা তা গ্রহণ করে নিলেন। এই সত্যের বিশ্বাস তাঁদের হৃদয়ের গভীরে শিকড় গেড়ে বসল। ফলে হৃদয় বুদ্ধি এমনকি তাঁদের চোখের দৃষ্টিও আল্লাহর ভয়ে, তাকওয়া ও পরহেজগারিতে অবনত হলো। আল্লাহর কসম, যদি তোমরা তাদের দেখতে তোমাদের এ কথাই মনে হতো যেন, সব কিছুই স্বচক্ষে দেখেই তারা বিশ্বাস করছেন। তর্কপ্রিয় ও গোড়া লোকদের মতো তারা ছিলেন না। এঁরা সেই পুণ্যবান জামাআত যারা আল্লাহর নির্দেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মস্তক অবনত করে দিতেন…। তাদের রাত্রি যাপন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে: “আর যারা রাত্রি যাপন করে আপন প্রতিপালকের দুয়ারে সিজদা ও কিয়ামে মগ্ন থেকে।”-(সূরা ফুরকান : ৬৪)।
আসুন, মাহে রমজানে অন্যান্য ভাল গুণাবলী ও মুমিনী চরিত্রের মধ্যে আমরা তাহাজ্জুদ নামাজকেও চর্চা করি এবং হৃদয় দিয়ে তা আল্লাহকে পাওয়ার অন্যতম উসিলা মনে করি।
আমাদের জন্য রমজানে প্রশিক্ষক হিশেবে কেউ থাকবেনা। আমাদের নিজেদের কেই নিজেদের প্রশিক্ষক হতে হবে। এই কাজ গুলো যদি আমরা পরিকল্পিত ভাবে আমাদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে করতে পারি তাহলে অবশ্যই এই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।
ব্যক্তি জীবনে পরিশুদ্ধতা আসলে সমাজ পরিশুদ্ধও শান্তি পূর্ণ হতে পারে। আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবার, সমাজও রাষ্ট্রীয় জীবনে, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালতে এমনকি গোটা সমাজ দেহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বসে আছে নানা অনৈতিকতা, অন্যায় অবিচার। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা বিদ্ধেষ পরশ্রীকাতরতার প্রভাব খুবই শক্তিশালী। এখানে মমত্ববোধ, ভালবাসা প্রায় দুষ্প্রাপ্য। মিথ্যা, পরনিন্দা ছাড়া যেন আমাদের সমাজ চলছে না। চাপাবাজি, ধোকাবাজি আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এখানে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। ন্যায় ইনসাফ ও সততা ক্রমে বিদায় নিচ্ছে আমাদের জাতীয় সামাজিক অঙ্গন থেকে। অহরহ সংঘটিত হচ্ছে জুলুম অত্যাচার-অবিচার। অর্থনৈতিক অঙ্গনে আমানতদারী নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে আমানতের খেয়ানত হচ্ছে। ঘুষ দুর্নীতি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এসব অপকর্মের কারণে মানুষের মধ্যে শান্তি নেই স্বস্তি নেই। আমরা যেন বেরিয়ে আসতে পারছিনা নীতিহীনতার এই দুর্ভেদ্য শৃংখল থেকে।
এই রামযানরে মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনার দাবি হচ্ছে সকল অন্যায়ও আল্লাহর অবাধ্য কাজ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদার গণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হয়ে যাও।’
অশ্লীলতাও একটি মারাত্মক ব্যাধি। অশ্লীলতার সয়লাবে আমাদের যুবসমাজ মেধাশূণ্য হয়ে যাচ্ছে। বেহায়াপনাও নগ্নতাকে আধুনিকতা মনে করা হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এই নগ্নতাও বেহায়াপনার অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ। ইসলামী পোসাক এবং পর্দার বিধানকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। টুপি, দাড়ি, পাঞ্জাবী, বুরকা ইত্যাদি ইসলামী পোষাককে কলুষিত করার জন্য নানা অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। পর্দার বিধানের প্রতি নারী সমাজকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
মাহে রামযান এসেছে মুক্তির বার্তা নিয়ে, পরিশুদ্ধ জীবন গঠন, শান্তি পূর্ণও পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত সমাজ বির্নিমানের সওগাত নিয়ে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যখন রামযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে তখন শয়তান এবং অবাধ্য জিন সমূহকে কয়েদ করে রাখা হয়, দোযখের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং একটি দরজাও আর খোলা থাকেনা এবং বেহেশতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয় এবং এসবের একটাও বন্ধ থাকেনা। আর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে থাকেন- হে পুণ্য অন্বেষনকারী! সামনে অগ্রসর হও, হে পাপান্বেষী! সংযত হও। আর আল্লাহ তায়ালা বহু লোককে নাজাত দান করেন।’
রমযান মাস মানুষের প্রতি ভালবাসাও সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। প্রতিদিনই আমরা মারামারি হানাহানি সংঘাত সংঘর্স প্রত্য করছি আমাদের সমাজে। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের লাশ পাওয়া যায় রাস্তা ঘাটে। তুচ্ছ স্বার্থের কারণে মানুষ মানুষকে মারছে র্নিদয় ভাবে। আজ মানব সামাজ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের দ্বারাই। এর কারণ হলো আমাদের মধ্যে ধৈর্য, সহানুভুতি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ইত্যাদি গুণাবলীর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই বৈশিষ্ট গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। ধৈর্য, মমত্ববোধও মানবতার প্রতি সহানুভুতি অতী উচ্চ মানবীয় গুণাবলী। মানুষকে ভালবাসলে, মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলে যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিও নৈকট্য লাভকরা য়ায় অনুরূপ মানব সমাজে মানূষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এই রামযান মাস আমাদেরকে ধৈর্যও মানুষের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শনের গুণ অর্জনের শিক্ষা দেয়। হাদীসের ভাষায় এ মাসকে বলাহয় ‘শাহরু মুয়াছাত’ অর্থাৎ পারস্পরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের মাস। হযরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এই মাস ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের পুরস্কার হচ্ছে একমাত্র বেহেশত এবং এই্ মাস পারস্পরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের মাস, এই মাসে আল্লাহ মুমিন বান্দার রিজিক বৃদ্ধি করে দেন।
যে ব্যক্তি এই মাসে কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার যাবতীয় (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং দোযখের আজাব থেকে সে নাজাত পাবে। আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউজে কাউসারের এমন পানি পান করাবেন যে, বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর পিপাসা অনুভব করবে না।’ মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের কত চমৎকার নমুনা পেশ করেছেন রাসূল (সা.) রামজান মাসের মধ্যে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে দারিদ্রতার অক্টোপাশে বন্দী আমাদের সমাজের বহু মানুষ। অর্থের অভাবে অনেক মানুষ চিকিৎসা করাতে পারেনা, কঠিন রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী, দারিদ্রতার অভিশাপে বন্দী অনেক প্রতিবন্দীকে আমরা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখি। অন্য দিকে একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত বিলাস বহুল জীবন যাপন করছেন। অর্থাৎ একই সমাজের মানুষ কেউ আছে পাঁচতলায় এবং কেউ আছে গাছ তলায়। সামাজিক বৈষম্যের এ বিভৎস চিত্র মুসলিম সমাজে কখনো কাম্য নয়। ইসলাম হচ্ছে মানবতার ধর্ম। ইসলামে মানব সেবাও মানব প্রেমের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেন, ‘সমস্ত মুসলমান জাতি মিলে একটা দেহের মত। একদেহের এক অঙ্গ যদি ব্যথিত হয় সারা অঙ্গ সেই ব্যাথা উপলব্দি করে। এক চোখে ব্যাথা হলে সারা শরীর সে ব্যাথা উপলব্দি করে। মাথায় ব্যাথা হলে সারা দেহ সেই ব্যাথা অনুভব করে।’ অর্থাৎ গোটা মুসলমান জাতি মিলে এমন এক একদেহ যে, কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
কিন্তু আমরা আজ রাসূল (সা.) এর সেই অনুপম আদর্শের উপর কতটুকু আছি? মাসব্যাপী সিয়ামসাধনার দাবী হল দুঃখী মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা, নিস্ব নিরন্ন অসহায় বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। একারণেই অসহায় মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু রাসূলে মাকবুল (সা.) রামযান মাস কে পারস্পরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে স্বীয় দাস-দাসী, চাকর বাকরের বোঝা হালকা করে দেবে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেন এবং তাকে দোযখ থেকে মুক্তি প্রদান করেন।’ পবিত্র রমযানের এই শিক্ষা এবং দাবী সমূহ যদি আমাদের সমাজে যথাযথ ভাবে প্রচলিত থাকত তাহলে ব্যক্তিও সমাজ অনেক উপকৃত হত, রাস্তার পাশে ফুটপাতে মুখ গুজে কাঁদতে হতনা অসহায় মানুষ গুলিকে।
রমযান মাসের রোজা মানুষের একনিষ্টতার উপর র্নিভরশীল। আল্লাহর হুকুমের প্রতি মানুষ একনিষ্ট না হলে রোজা পালন করতে পারবেনা। মানুষ সিয়াম সাধনা করে কেবল আল্লাহর জন্য। হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন যে, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষ কেবল আমার উদ্দেশ্যেই রোজা রেখে তার প্রবৃত্তি দমন করেছে এবং পানাহার ত্যাগ করেছে। সুতরাং এর পুরস্কার আমি নিজেই (যত ইচ্ছা) দান করব।’
সহনশীলতা ও রোজাদারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট। রাসূল (সা.) বলেন, ‘রোজাদারের জন্য উচিৎ গালি-গালাজ হতে বিরত থাকা এবং চিৎকার করে কথা না বলা। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে আসে তখন সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার ব্যক্তি।’ এই একনিষ্টতা এবং সহনশীলতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের জন্য এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন। এই মহৎ গুণ গুলো যদি আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমানে থাকত তাহলে জাতীয় সমাজিক ভাবে আমরা অনেক ঝগড়া বিবাদও ফিৎনা ফাসাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারতাম।
রোযা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিলো।’ (বাকারা-১৮৩) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যত শরীয়ত কিংবা হেদায়াত নাযিল হয়েছে, তার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রোযার বিধি-বিধান ছিল। আজও হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, কিংবা খ্রীস্টান প্রভৃতি প্রাচীন ও বড় বড় ধর্মে উপবাস করার নীতি প্রচলিত আছে। অবশ্য ইসলামের রোযা এবং এসব ধর্মীয় উপবাসের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
ইহুদীদের উপবাস হলো প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানরা সকলেই বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্ব-স্ব নিয়ম অনুযায়ী তাদের উপবাস ব্রত পালন করে। বাইবেলের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত ঈসা (আ.) চল্লিশ দিন পর্যন্ত রোযা রাখতেন। নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখিত হয়েছে: `And when he (Jesus) had fasted forty days and forty nights, he was afterward unhungered.’ (Mathew-4:2) রোযাদারদের সম্পর্কে বাইবেলে ঈসা (আ.) এর উক্তি এভাবে উল্লেখিত হয়েছে ‘Blessed are they which do hunger and thirst after righteousness : for they shall be filled.’ (Mathew-5: 6)
‘রোযা’ ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম একটি ভিত্তি। রোযা ফারসী শব্দ। এর আরবী প্রতিশব্দ হলো ‘আস্-সাওম’। যা আল্-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে আত্মসংযম, কঠোর সাধনা, বিরত থাকা। এর প্রতিশব্দ ‘আল ইমসাক’। ইংরেজী পরিভাষায় হলো এর্ট্রধভথ. আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে রোযার নিয়্যাতে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকার নামই সাওম বা রোযা। রোযা রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৫তম বর্ষ তথা ২য় হিজরীতে ফরজ হয়। খোদাভীতি অর্জনের উদ্দেশ্যেই রোযাকে ফরজ করা হয়েছে। সুরা বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াতে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘যাতে তোমরা পরহেজগারী বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো।’
মু’মীন জীবনের চূড়ান্ত সফলতা অর্জনে রোযার বিকল্প নেই। রোযা ঈমানদারদের সেই মানে উন্নীত করে, যা আল্লাহর সন্তোষ অর্জন তথা জান্নাত প্রাপ্তির গ্যারেন্টি। রোযার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। ‘হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য, কেবল রোযা ছাড়া। কারণ তা আমার জন্য এবং আমি তার প্রতিদান দেব। আর রোযা ঢালস্বরূপ। কাজেই তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে, সে যেন অশ্লীল কাজ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে তাহলে তার বলা উচিত, আমি রোযাদার। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তার কসম, রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও সুগন্ধযুক্ত। রোযাদারের দু’টি আনন্দ, যা সে লাভ করবে, একটি হচ্ছে সে ইফতারের সময় আনন্দিত হয়। আর দ্বিতীয় লাভ করবে যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সে তার রোযার কারণে আনন্দিত হবে।’ (বুখারী ও মুসলিম) রোযাদারের সফলতা সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি বর্ণিত হাদীস হলো: ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈমান ও সওয়াবের আশায় যে লোক রমযান মাসের সাওম পালন করবে, তার পূর্বের ও পরের সব গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী) মুসলিম শরীফে বর্ণিত হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত আরেকটি হাদীস: ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, রমযান মাসে আসলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে বন্দী করা হয়।’
অনেকেই মনে করেন, রোযা রাখলে শরীর দুর্বল হয়, শারীরিক অসুস্থতার সৃষ্টি হয় কিংবা অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়। রোযা দ্বারা মানুষের শারীরিক দুর্বলতা কিংবা অসুস্থতা নয়, বরং সুস্থতা অর্জিত হয়। রোযা পালনে শারীরিক কল্যাণ সাধিত হয়। কায়রো হতে প্রকাশিত ‘Science Calls for Fasting’ গ্রন্থে তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন : ‘The power and endurance of the body under fasting conditions are remarkable. After a proper day’s fast, the body is literally born afresh.’ জানা যায় যে, দেহের বেশীর ভাগ রোগ সৃষ্টির কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ। দেহযন্ত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে টকসিন নামক এক প্রকার রস জাতীয় বিষ সঞ্চিত হয়ে থাকে। বাড়তি খাদ্যদ্রব্যাদি ক্ষেত্র বিশেষে স্বাস্থ্য রক্ষায় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাসব্যাপী রোযা পালন দেহের পরিপাকযন্ত্র এক প্রকার পরিশুদ্ধি লাভের অবকাশ পায়। এই সময় পরিপাকযন্ত্র যে অবসর পায়, তার ফলে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায়। এতে দেহের বাড়তি ওজন, রস ও চর্বি ইত্যাদি হ্রাস পায়।
মাহে রমযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। প্রকৃতপক্ষে এ মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির উৎস হলো, এ মাসে মানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল্-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘রমযান মাস, এ মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্য পথ নির্দেশনা। সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।’ যুগে যুগে মানবতাকে সত্য, সুন্দর, চির শান্তি ও মুক্তির পথ দেখিয়েছে এবং দেখাবে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। কুরআন আমাদেরকে দুর্বল কিংবা হতভাগ্য করার জন্য প্রেরিত হয়নি। কুরআন এসেছে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করার জন্য। আজ সে কুরআন যথাযথভাবে অনুসরণ-অনুকরণ না হওয়ার কারণেই আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদেরকে কঠিনভাবে দমন নির্যাতন করার পরও কেন বার বার তারা আবার জেগে ওঠে, কোথায় শক্তির সেই আধার? এ প্রশ্নোত্তরের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সেক্রেটারি গোল্ডস্টোনকে দায়িত্ব দিয়ে উপমহাদেশে পাঠিয়েছিল ইংরেজ সরকার। দীর্ঘ প্রচেষ্টা, জরিপ ও গবেষণা করে গোল্ডস্টোন পার্লামেন্টে যে রিপোর্ট জমা দেন, তার সারাংশে একটি মন্তব্য করেন। তার ভাষায় : `So long as the Muslim have the Quran we shall be unable to dominant them. We must either take it from them or make them lose their love of it’.
মাহে রমযান মুসলমানদের বিজয়ের মাস, সফলতার মাস। ১৭ রমযান বদরের প্রান্তরে মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছিলো।
এ মাস থেকে সফলতা আর বিজয়ের শিক্ষা নিতে হবে। ইসলাম বিরোধী শক্তি সত্য ও সুন্দরের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে বদ্ধপরিকর। ইসলামের পথ থেকে এর অনুসারীদের থামিয়ে দিতে তাদের কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র চক্রান্ত অব্যাহত আছে। মুসলমানদেরকে কুরআনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে হবে। হাদীসের অনুসরণে যত্নবান থাকতে হবে। রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শের অনুকরণে আপোষহীন ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের নিজেদেরকে মাহে রমযানকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর রঙে রাঙাতে হবে। ইসলামের শাশ্বত পথে আমাদের পথচলা দৃঢ় হোক; হোক আরও অটল-অবিচল।
মাহে রামযানের মর্যাদা এবং ফজিলত মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কারণে। রমযান মাস পবিত্র কোরান নাজিলের মাস। রমযানুল মোবারকের আহবান হলো ‘আল কোরআনের সমাজ গড়।’ আমরা যদি আল কোরআনের রঙ্গে আমাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সাজাতে পারি তাহলে আমরা হব শ্রেষ্ট মানুষ, শ্রেষ্ট জাতি। ইতিহাস আমাদেরকে শ্রেষ্টত্বের মর্যাদা দেবে, সম্মানের আসনে আমাদেরকে বসাবে
মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সুস্থতার সঙ্গে এবং তাঁর ইবাদতে রত থেকে পবিত্র মাহে রমজান কাটানোর তৌফিক দান করুন।