শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:১৭

মানুষ ক্ষমতা ছাড়ে না, ক্ষমতাই মানুষকে ছেড়ে যায়

মানুষ ক্ষমতা ছাড়ে না, ক্ষমতাই মানুষকে ছেড়ে যায়

এইতো ক’দিন আগে ঢাকা ও চট্রগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। ঢাকার নতুন দুই মেয়র দায়িত্ব নিয়ে এক মাসেরও বেশী সময় পার করেছেন।

যদিও নির্বাচনটি নানা কারণে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ, এরপরও তিন নগরের অধিবাসীরা দীর্ঘদিন পর পেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এতে তাদের প্রত্যাশার শেষ নেই।

নতুন মেয়রদেরও নতুন নগরী গড়ার স্বপ্নেরও ইয়ত্তা নেই। ব্যাপক ঢামাঢুলে  প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচিত তিনসিটি মেয়রের শপথ অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী নাগরিকসেবায় নতুন মেয়রদের আত্মনিয়োগের আহবান জানিয়েছেন।

এখন আমাদের দেখার পালা- তারা তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করতে পারেন এবং কতটা নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারেন।

অন্যদিকে আমরা কি দেখছি! ইতোপূর্বে সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়রগণ একের পর এক জেলে যাচ্ছেন। হচ্ছেন বরখাস্ত। এভাবে মামলার

অজুহাতে নির্বাচিত মেয়রদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোকদের মেয়র পদে বসানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের অন্য জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেও একই দশা। এছাড়াও আমরা যদি লক্ষ্য করি নারায়নগঞ্জ সিটিকে, সেখানেও কিন্তু অন্যদের মত অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী সেলিনা হায়াত আইভী মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা না পেয়েও তার ফ্লাগ কার ব্যবহার করছেন নির্দ্বিধায়। খুবই দাপটেই মেয়রগিরি করছেন।

কিন্তু এব্যাপারে সরকারের কোন শ্রেয় নেই। তাই তো বলি- নিজ দলের লোক বলে কথা। আমরা জানি, এরই মধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের মামলায় এখন কারাগারে এবং মেয়র পদ থেকেও তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজীপুরের মেয়র আব্দুল মান্নানও দীর্ঘদিন থেকে কারাগারে।

রিমান্ডের মুখোমখি হয়েছেন একাধিকবার। তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। গেল ৭ মে রাজশাহী সিটি মেয়র বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে বরখাস্ত করা হয় পুলিশ সদস্য সিদ্ধান্ত মামলার অভিযুক্ত হবার ফলে। তিনি হাইকোর্টে গিয়েও পদ রক্ষা করতে পারেননি। ইতোমধ্যে বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামালের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলায় খুলনা

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ, চলতি মাসেই এর শুনানি রয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো তাদের বরখাস্তের সময়ও প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।

এদিকে রাজশাহীর মেয়র বুলবুল বরখাস্তের পর আমরা দেখলাম সরকারের এক নাটকীয় ভুমিকা । আইন অনুযায়ী প্যানেল মেয়র-১, ২ ও ৩ ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার কথা কিন্তু এক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আওয়ামী পন্থী সাধারণ কাউন্সিলর (২১ নং ওয়ার্ড) নিযাম উল আযীমকে।

অথচ, স্থানীয় সরকারের আইনে (সিটি কর্পোরেশন) ২০০৯-এর ১২ ধারায় যে কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় আদালত চার্জশিট গ্রহণ করলে তাকে সাময়িক অপসারণের বিধান রয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের কোনো মেয়রকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রদান করা হইলে উক্ত আদেশপ্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত মেয়র তাহার দায়িত্ব জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মেয়র প্যানেলের সদস্যের নিকট হস্তান্তর করিবেন…।

কিন্তু রাসিকের প্যানেল মেয়র-১ আনোয়ারুল আমিন আজব ও প্যানেল মেয়র-২ নুরুজ্জামান টিটো দুজনই পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ হত্যার মামলার আসামি। এর মধ্যে আজব রয়েছেন কারাগারে। আর টিটো প্রায় ৫-৬ মাস ধরে আত্মগোপনে। সে হিসেবে প্যানেল মেয়র-৩ নুরুন নাহার ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু আমরা পত্রপত্রিকা মারফত যা জানলাম তাতে, সরকারদলীয় বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপি নেত্রী প্যানেল মেয়র নুরুন নাহারকে দায়িত্ব না নিতে ভয়ভীতি দেখানো হয়। ভারপ্রাপ্ত মেয়র হলে তার বিরুদ্ধেও মামলা দেয়া হবে- এমন হুমকির প্রেক্ষিতে আশংকায় ছিলেন তিনি । আর এ কারণে মেয়র বুলবুল বরখাস্ত হওয়ার পর থেকে রহস্যজনকভাবে কয়েকদিন নুরুন নাহারকে উধাও হয়ে থাকার কথাও শুনেছি আমরা।

অবশেষে তার আর ভাগ্যে জুটল না ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব নেয়া । মেয়র হলেন আওয়ামী পন্থী সাধারণ কাউন্সিলর (২১ নং ওয়ার্ড) নিযাম উল আযীম। এভাবে আমরা মেয়র কিংবা অন্য জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে দখলের আরেকটি নতুন সংস্কৃতি চালু হতে প্রত্যক্ষ করছি।

যে যাই বলেন না কেন, বিচার আমি মানি। তবে দুঃখিত, তাল গাছটা আমার! অর্থাৎ মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাতখুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করে সাইজ করা যেন আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। আজ আমাদের সমাজ ও  রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রেও যেন এই নোঙড়া সংস্কৃতিটা খুবই বাস্তবতা। জানি না, এই সংস্কৃতি আমাদের কতদূর নিয়ে যাবে!

প্রসঙ্গ, কিছুদিন আগে স্থানীয় সরকারে নাগরিকসেবার হালচাল নিয়ে ‘রাজনৈতিক সংকটে জনপ্রতিনিধিরা ফেরারি, জনসেবা তলানিতে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে দেশের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে কী চলছে আর নাগরিক সেবার দৈন্যতা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করি।সেই কলামেও সদ্য বরখাস্ত হওয়া রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের আত্মগোপনে থাকা এবং অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ কয়েক শ’ জনপ্রতিনিধির মামলায় জড়িয়ে পালিয়ে থাকা এবং বরখাস্ত হওয়ার কথা তুলে ধরেছিলাম।

এসব প্রেক্ষিতে দেশে আজ গণতন্ত্র, আইনের শাসন কিংবা দায়িত্ববোধ যাই বলুন না কেন, এ সব কিছুই যেন খুবই এক বাস্তবতার সম্মুখীন। আওয়ামী লীগের মেয়র হলে সোনায় সোহাগা জীবন যাপন! বিএনপি কিংবা অন্য কোনো বিরোধী মতের হলেই মামলায় জড়িয়ে বরখাস্ত? আজকাল এভাবে রাজনৈতিক কারণে জনপ্রতিনিধির বরখাস্ত করার বিষয়টি যেন ধূলোখেলায় পরিণত হয়েছে। যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মানুষের চাওয়া-পাওয়া হলো নাগরিকসেবা।

আর মেয়রদের দায়িত্ব হলো প্রতিশ্রুতি পূরণ করা । আর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য প্রয়োজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে অবাধ ক্ষমতা ।তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা সেটা কতটুকু ভোগ কিংবা প্রয়োগ করতে পারছেন?

বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও

অবাধ ক্ষমতা দেয়ার কথা বললেও কার্যত: সেটা তারা করতে পারেনি কিংবা করেনি।

এখন সিটি মেয়র থেকে শুরু করে পৌর মেয়র, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের ওপর

 

আমলাতন্ত্রের খড়গ নামিয়ে মূলত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। জনগণের ভোটে

নির্বাচিত মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানরা তাদের প্রাপ্য ক্ষমতা পাওয়া দূরে থাক

উল্টো রাজনৈতিক মামলার খড়গে পড়ে একের পর এক বরখাস্ত হচ্ছেন। তবে আমরা

সবাই এটা জানি যে, জনগণের ক্ষমতায়ন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে না

দিয়ে কখনোই নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তাই বলে আইন ও জবাদিহিতার ঊর্ধ্বে কেউ নন। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য

বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও একেবারে তুলসি পাতা নন, তারা এই

নতুন সংস্কৃতি চালুর জন্য কম দায়ি নন। কেননা, মেয়র কিংবা অন্য জনপ্রতিনিধি

নির্বাচিত হবার পরও নিজেদের পদের দায়িত্ববোধকে দলের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন।তারা

জনগণের সেবার দায়িত্ববোধকে ভুলে গিয়ে দলীয় নেতানত্রীদের খুশি করতে কিংবা

ভবিষ্যতে আরো বেশি ক্ষমতাবান হতে অন্য সবদলীয় নেতাদের মতোই রাজনীতির

মাঠে আচরণ করেছেন, তারা রাজনৈতিক সহিংসতায় অংশ নিয়েছেন। যা কোনোভাবেই

জনগণের কাম্য নয়। আর এই সুযোগটাই সরকার ও তাদের লোকজন সময়ের মোক্ষম

হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।

 

প্রসঙ্গত, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের কথাই একটু উল্লেখ করি,

রাজশাহীতে দীর্ঘদিন অবস্থান করার সুবাদে যাকে দীর্ঘদিন থেকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি

ও জানি। কেননা, নির্বাচনকালীন এবং এর কিছুসময় পরও গবেষণার কাজে আমি

রাজশাহীতে ছিলাম। তাই প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার- নগরবাসীর

আকাশচুম্বী প্রত্যাশায় বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হবার পর তিনি কিভাবে ধরাকে

সরা জ্ঞান করে ফেলেছিলেন। যার ফলে বছরখানেকের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা ও

ভাবমূর্তির অধ:পতন ঘটে। যে নাগরিক পরিষদের ব্যানারে তিনি নির্বাচন করেন

কয়েকমাসের ব্যবধানে ওই সংগঠনের নেতাদের মুখেই বুলবুলের সমালোচনা শুনতে পেয়েছি।

আর কোনো কিছু এখানে নাইবা উল্লেখ করলাম।

 

এরপরও বলবো- বরখাস্তের এ সংস্কৃতি আমাদের ভবিষ্যতের খুবই ভয়ঙ্কর আলামত।

বিরোধী জনমত বা মানুষের মত-স্বাধীনতাকে গায়ের তথা বন্দুকের গুলির জোরে

স্তব্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে রেখে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার

মানসিকতা থেকেই এই সমস্যাটা তৈরি।মহাজোট সরকার বিশেষ করে সরকার প্রধান

চিন্তা চেতনায় আরও যে একটা ভয়ানক, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী মনোভাব

শক্তভাবে গেড়ে বসেছেন তা হল ক্ষমতায় থাকতে সকল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা।

 

কিন্তু আমাদের সবার জানা উচিত, এই দুনিয়াতে মানুষ কখনো ক্ষমতা ছাড়ে না,

ক্ষমতা মানুষকে ছেড়ে যায়। ফলে ক্ষমতাসীনদেরও ভাবা উচিত- আজকের এই সীমাহীন

ক্ষমতা হয়তো কোন একদিন হাত ছাড়া হয়েও যেতে পারে, সে দিনকালে এ সংস্কৃতি

তাদেরকে কি উপহার দিতে পারে!

 

কোরআনের সূরা আল ইমরানের একটি আয়াতের কথা এখানে নাইবা উল্লেখ করলাম।

সেই ছোটকাল থেকে ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানাদের কাছ থেকে ওয়াজ শুনে এসেছি-

দুনিয়ার ক্ষণকালের ক্ষমতা বা অক্ষমতা দিয়ে মহা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে কিছু

মানুষকে মানবতার কল্যাণে বাছাই করতে চান। সে বাছাই পরীক্ষায় আমরা ক্ষমতাবানরা

সবাই।

আর স্বৈরাচারী শাসকরা ধরার বুকে অসাম্য ও অন্যায়ের দাবানলে দ্বগ্ধ করে

বণী আদমকে পদপিষ্ট করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে চরম নিষ্ঠুরতম পথ বাছাই করে

নেয়।

ফলেস্বৈরাচারী কোন শাসক যখন একটি জনবসতির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে

তখন তারা সেই জনপদের মানুষদের সবকিছু তথা সব নিয়ম-নীতি ধ্বংস করে ফেলে।

তাই সবশেষে সেই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে স্যারদের মুখ থেকে বারবার উচ্চারিত

একটি ইংরেজি প্রবাদের কথা উল্লেখ করেই আজকের এই কলামের সমাপ্তি টানতে চাই-

 

Power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely.-(Lord Acton)

 

লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, শিক্ষা-সমাজ বিষয়ক গবেষক ও কলাম লেখক । sarderanis@gmail.com




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024