সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকতা ও নাগরিকের বাকস্বাধীনতার উপর যে ধরনের খড়গ হস্ত চালানো হচ্ছে, তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এতদিন ধরে আইসিটি এ্যাক্টের অপব্যবহারের যে আশঙ্কা করেছিলাম তা যেন এখন সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এই আইসিটি এ্যাক্ট অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাগরিকদের মতপ্রকাশের ন্যূনতম অধিকারটুকু যেমন খর্ব হচ্ছে, তেমনি জীবনাশঙ্কার কথা প্রকাশ করাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে সরকারের এর চেয়ে অগণতান্ত্রিক আচরণ আর কী হতে পারে! পরপর কয়েকটি ঘটনায় আইনের অপপ্রয়োগ, সরকার ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ভূমিকায় আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। জানিনা, সামনে আর কত সংকোচিত করা হবে নাগরিকদের অধিকার।
আমরা কী লক্ষ্য করলাম-
এক. গেল রোববার কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে। তার অপরাধ- থানায় নিরাপত্তাহীনতার জিডি করতে ব্যর্থ হয়ে একজন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের একজন শীর্ষ ধনকুবের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। গ্রেফতারের পর প্রবীর সিকদারকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর তবে আওয়ামী লীগ সমর্থক এই সাংবাদিককে গ্রেফতারের পর থেকে মন্ত্রীসহ শাসকদলের একাংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়।এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে এ ঘটনার নিন্দা জানানো হয়।
এরপর রিমান্ড মঞ্জুরের ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যেই নজিরবিহীনভাবে তিনি জামিন পান। জামিন আদেশের পরপরই কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। প্রবীরকে এ জামিন দেয়ার ঘটনাকে আমরা সবাই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, দেশের আইন কী স্বাভাবিক গতিতে চলছে, না তাকে ভিন্নভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে?
আমার জানামতে, প্রবীরের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে করা এই মামলাটি জামিন অযোগ্য। কিন্তু রাতারাতি কীভাবে জামিনযোগ্য হলো—এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমার মতো আর কারো কাছেই নেই। বিষয়টি সরকারের লোকজনই মালুম।
দুই. প্রবীর সিকদারের গ্রেফতারের একদিন পরই মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদকে আটক করা হয়। এরপর পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে হাজির করলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, তাকে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
শওকত মাহমুদ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হলেও তিনি একজন প্রবীণ সাংবাদিক নেতা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। এক সময় বৈশাখী টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ছিলেন। শওকত মাহমুদ গাড়ী পুড়িয়েছেন তা সরকারের অন্ধভক্ত কিছুসংখ্যক লোকজন ছাড়া দেশবাসীর আর কারো কাছে এ ধরনের কথা সামান্যত বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে বলে আমি মনে করি না।
ফলে মামলাটি যে কতটা হাস্যকর ও সাজানো তা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, প্রবীর সিকদার বিলম্বে হলেও আদালতে যে আচরণ পেয়েছেন শওকত মাহমুদ কী তেমন তিন. সম্প্রতি দুদকের মামলায় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ৩ বছরের দন্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। কিন্তু দুদক মামলাটি দিয়েছিল সম্পদের হিসাব না দেয়ার কারণে।
অন্যদিকে মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের মাওলানা সাঈদীর মামলা নিয়ে বিচারপতির স্কাইপি কেলেঙ্কারীর তথ্য ফাঁসের অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে ২০১৩ সালের ১১এপ্রিল গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দেয়া হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। এর আগে আদালত অবমাননার অভিযোগে তাকে সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালে ব্রিটিশ আইনে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
এক্ষেত্রে সমালোচকরা বলছেন, বাংলাদেশের আদালতে সবক্ষেত্রে সমান আচরণ মেলে না। তাই একই আদালত সম্প্রতি একই ধরনের মামলায় দৈনিক জনকণ্ণ্ঠের সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদকে প্রতীকী সাজা এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে। অথচ মাহমুদুর রহমানকে গুরুদণ্ড দেয়া হয়।
চার. বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের দুই সংবাদকর্মীকে বুধবার মারধর করেছেন নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিভাগে আইডিয়া প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবদুল বারীর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। মারধরের শিকার দুজন হলেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক জি এম মুস্তাফিজুল আলম ও ক্যামেরা পারসন রিপু আহমেদ।
পাঁচ. গত সপ্তাহে বাংলাদেশের একটি আদালত জাবির শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকারকে তার অনুপস্থিতিতে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকারের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় রাজনীতিকদের দায়ী করে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে কিভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে পেরেছেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি ২০১১ সালে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটিই তার অপরাধ। এ মন্তব্যের কারণে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারকরা তার দোষ খুঁজে পেয়েছেন।
ছয়. যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির এক নেতার সাথে মোবাইলে কথা বলায় রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের অভিযোগে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেফতার করা হয় । তাকে একাধিকবার রিমাণ্ডেও নেয়া হয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি কারাগারে রোগে-শোকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। এবার পালা শওকত মাহমুদ ও প্রবীর সিকদারের । প্রবীর ইতোমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন।
অন্যদিকে শওকত মাহমুদ মুক্তি পাওয়া তো দূরের কথা। তাকে তিনদিনের রিমাণ্ডে নিয়েছে পুলিশ। ফলে আইনী সুরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর আদালতই এখন কাঠগড়ায়। এরইমধ্যে প্রবীর সিকদারের গ্রেফতার আইন ও ক্ষমতার নিকৃষ্ট প্রয়োগ মন্তব্য করে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলেছেন, প্রবীরকে নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে যা করা হচ্ছে তা নজিরবিহীন ও বলদর্পী ক্ষমতার বর্বর চর্চা।। এ ঘটনাকে ‘আইন ও ক্ষমতার নিকৃষ্ট প্রয়োগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নেতারা। সরকারের এসব তৎপরতার সাথে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের কোন সম্পর্ক নেই; এইসব তৎপরতা চরম অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনেরই বহিঃপ্রকাশ। তারা অবিলম্বে অগণতান্ত্রিক আইসিটি এ্যাক্ট বাতিলেরও দাবি জানান
এছাড়াও সাংবাদিকদের ওপর হামলামামলা তো আছেই। নানাভাবে গণমাধ্যম কর্মীরা হচ্ছেন লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত। নিরাপত্তার অভাবে গণমাধ্যম হয়ে পড়ছে কোনঠাসা; আর শাসক-কর্তাদের রক্তচক্ষু, আমলাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং দুনীতিবাজ ও চেরাকারবারীরা গণমাধ্যম কর্মীদের দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল আগস্ট, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ১১জন সাংবাদিককে নিহত হয়েছেন।
এই সময়ে আহত হয়েছেন আরো ১০৯৩ জন সাংবাদিক। ফরহাদ মাজহার ও সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির করুণ পরিণতির কথা তো আমাদের সবারই জানা। এরপরও আমরা আজ যখন প্রবীর সিকদার ও শওকত মাহমুদ ইস্যুতে সরকারের হীন ভুমিকার নিন্দা-প্রতিবাদ করছি তখন আমার দেশ’র সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে জেলে আটক, তেমনি ৩ মার্চ থেকে ইটিভির সাংবাদিক কনক সারো্ওয়ার এবং ৬ জানুয়ারি থেকে ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামসহ আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আটক হয়ে কারানির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এরপরও গণমাধ্যমের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন, ধর্মীয় উগ্রপন্থী কর্তৃক মুক্ত চিন্তার লেখক ব্লগারদের হত্যার ঘটনা তো অহরহ ঘটেই চলেছে । এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩-এর ৫৭ ধারা সংশোধন এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪ তে বেশ কিছু ধারা সংযোজিত করেছে সরকার, যা গণমাধ্যম এবং ব্যক্তির স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
অথচ আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এই সমাজ বিবর্তনের ধারায় রয়েছে এই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরাট অবদান। আমরা কী আজ সাংবাদিকদের সেসব অবদানের কথা স্বীকার করছি? তাই আজ স্মরণে পরে প্রেসিডেন্ট জেফারসনের সেই কথা। তিনি রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবাদমাধ্যমের অসীম গুরুত্ব ও অপরিসীম ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‘যদি আমাকে বলা হয় কোনটা বেছে নেব সংবাদক্ষেত্র ছাড়া সরকার, না সরকার ছাড়া সংবাদক্ষেত্র? আমি বেছে নেব শেষেরটিকেই।” কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা যেন এই গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখেন। তাদের কথাবার্তা ও চালচলনেও সেটা ফুটে উঠছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।স্বাধীনতার পর জাতি পাকিস্তানীদের বঞ্চণা থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের প্রত্যাশা করেছিলো। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর জাতির সেই প্রত্যাশা কী পূরণ হয়েছে? না, সেই প্রত্যাশা যেন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আজ বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এক নজিরবিহীন আক্রমণের সম্মুখীন।
বাকস্বাধীনতা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারের উচিত নাগরিকের বাকস্বাধীনতা হরণে অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকে সাংবিধানিক নাগরিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। যত দ্রুত সম্ভব এসব করা উচিত। কেননা, যতদিন ধরে সরকার নাগরিকের বাকস্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখবে, ততদিন রাষ্ট্র-সমাজে অস্থিরতা বিরাজমান থাকবে।
আমাদের সার্বিক উন্নয়ন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সুসংহত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। আর দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে প্রথেমেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তাই আশা করবো- চরম অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে সরকার সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তরিক হবে।
সবশেষে, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদসহ কারাবন্দি সাংবাদিকদের অবিলম্বে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, গবেষক ও কলাম লেখক। ই-মেইল:sarderanis@gmail.com