শুক্রবার রাতে একটি ইংরেজি দৈনিক পড়ছিলাম। হঠাৎ একটি নিউজের মাঝে আমার দু’চোখে আটকে গেল। “Strong UN. Better World” বাক্যটি বারবার পড়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোনো মতেই যেন বাক্যটির সাথে বাস্তবতা মিলাতে পারছিলাম না। তাই ওই বাক্যটি নিয়েই আমার আজকের এ লেখা।
আমরা সবাই জানি আজ ২৪ অক্টোবর। ৭০তম জাতিসংঘ দিবস। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদা ও বিভিন্ন আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৪৫ সালের এই দিনে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ব সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। লিগ অব নেশনস বিলুপ্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতার এই আন্ত:রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি গঠন করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রায় চার বছরের চেষ্টা ও ধারাবাহিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে আজকের এই দিনে এসে প্রাথমিকভাবে ৪৬টি সদস্য-দেশ জাতিসংঘ সনদকে অনুসমর্থন দেয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২৪ অক্টোবরকে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
সেই আলোকে এবার জাতিসংঘ দিবসের স্লোগান হলো- “Strong UN. Better World” অর্থাৎ আরো সুন্দর বিশ্ব পেতে জাতিসংঘকে শক্তিশালী করুন। আসলে কি বিষয়টি তাই, জাতিসংঘকে শক্তিশালী করলে আমরা আগামী দিনে মানবাধিকার সমুন্নত রক্তপাত ও হানাহানিমুক্ত নতুন বিশ্ব পাবো? না, আরো বেশি রক্তপাত দেখতে পাবো?
অবশ্য প্রশ্নটির উত্তর বেশ জটিল। কেননা, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার গেল ৬৯ বছরের ইতিহাস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জন্য খুব শুভকর নয়।
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবীয় অধিকার কমিশন কর্তৃক পেশকৃত মানবাধিকার সনদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত ও ঘোষিত হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল মানুষ যে সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবার আকাঙ্খা হৃদয়ে গভীরভাবে পোষণ করে থাকে, সেগুলো উক্ত ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়।
ঘোষণাপত্রের মুখবন্ধেই ব্যক্তি স্বত্তার যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। ঘোষিত সার্বজনীন অধিকারগুলো সর্বত্র এবং সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছে।নিঃসন্দেহে ইহা জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য সফলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কিন্তু আজ ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসে এসে প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘ কি বিশ্বের মজলুম জনতার সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম? পেরেছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের হানাহানি বন্ধ করতে, না এই সংস্থাটির নীরবতায় আরো বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে? না কোনো একটি বিশেষ পক্ষ কিংবা মহলের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত!
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে এমন কথা অহরহই শুনা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কেননা, পশ্চিমাদের ‘গ্রেট গেম’ আমরা দেখলাম। গাজায় ইসরাইল মুসলমানদের গণহত্যার শিকারে পরিণত করেছে; তাদের শহরগুলো ও ঘরবাড়ি করা হয়েছে ধ্বংস।
সম্প্রতি গাজায় দুই হাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো চলছে সেই নিধন। তাদের মধ্যে ছোট্ট শিশু, নারী, বৃদ্ধ লোকজনই বেশি। হাজার হাজার মানুষ হারিয়েছেন হাত-পা। ইউরোপ ও আমেরিকা তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি।
উদ্বিগ্ন হয়নি গাজার ঘটনায়। আসলে আরো মুসলমান হত্যা এবং তাদের বসতি ও জনপদ ধ্বংসের জন্য ইসরাইলকে দিয়েছে অর্থ ও অস্ত্র। আজ ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনে কি ঘটছে? এসব বিষয়ে কি জাতিসংঘের কোনো কিছু করার নেই?
থাক, বিশ্বের কথা বাদই দিলাম। আমরা যদি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি তাহলে কি দেখতে পাই।এইত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে এসেছিলেন অস্কার ফার্নান্দেস তারানকো। তিনি এসে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করলেন অনেক দৌড়ঝাপ পাড়লেন।
এতে দেশবাসী আশাবাদী হয়েছিলেন এবার অনন্ত একটা সমঝোতা হবে। কিন্তু আমরা কি দেখলাম- কোন ধরনের সমাধান না করেই তিনি রাতের আধারে ঢাকা ছাড়লেন।
এতে দেশ আরো বেশি সংহিংসতার দিকে এগুলো, প্রাণ গেল অসংখ্য মানুষের, অপমৃত্যু হলো গণতন্ত্রের। যার রেশ চলছে এখনো । এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব বললেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চাই’।
জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রক দেশগুলোর হর্তাকর্তারা্ও একই ধরনের বাণী শুনালেন বাংলার বনি আদমদের। এর কিছুদিন পর আমরা কি দেখলাম- জাতিসংঘ আমাদেরকে পুরস্কারে ভুষিত করলেন।
অনেকের ধারণা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ যদি এমন সমঝোতার নাটক মঞ্চস্থ না করতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন না হলেও এভাবে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হতো না এমনটা জোর দিয়েই বলা যায়।
এছাড়া কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের রাষ্ট্র-সরকার প্রধানদের আহবান জানিয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ডের মতো অমানবিক শাস্তির বিধান রহিত করার জন্য। এর জবাবে আমাদের সরকার প্রধান ও মন্ত্রী-এমপিরা কী বলেছিলেন তা তো আমাদের সবারই জানান!
এছাড়া আজ যখন বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ দিবস পালিত হচ্ছে তখন আজ ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনে কি ঘটছে তা আমরা জানি।বর্বর ইসরাইলিরা ফেরাউনের মত প্যালেসস্টানী মুসলিম নারী শিশুদের কীটপতঙ্গের ন্যায় মারছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া র বহু মুসুল্লি এবার ঈদের নামায পড়তে গিয়েও লাশ হয়েছেন।
গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে হাজার হাজার নারী-শিশু ইউরোপের বিভিন্ন বর্ডারে ঝড়-বৃষ্টি আর কনকনে শীতে সামান্য মাথার গোছার ঠাঁইয়ের জন্য যখন আহাজারি করছে।
এ ছাড়া আছে সঙ্ঘাত, সন্ত্রাস আক্রান্ত পাকিস্তান, মিসর, সুদান প্রভৃতি দেশের মানুষ নিজ মাতৃভুমি থেকে বিতাড়িত। তাদের আশ্রয় নেই, নেই খাবার, জীবনধারণের উপকরণ নেই। তাই তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বর্ডারে যখন আহাজারি চলছে, তখন জাতিসংঘের হর্তাকর্তারা অজ্ঞাত কারণে নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রক দেশের হর্তাকর্তাও সিরিয়ায় সন্ত্রাস দমনের নামে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে এ নিয়ে তামাশা করছেন।
অন্যদিকে এইতো কিছুদিন আগে জাতিসংঘের সদস্য বিদায়ী সভাপতির বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ তুলেছে খোদ পশ্চিমারাই। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাবেক ওই সভাপতির বিরুদ্ধে চীনা ধনকুবেরের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র।
যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই জন অ্যাশ অ্যান্টিগা ও বার্বুডার প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিত্ব করেন। আরও পাঁচজনের সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ।
গণমাধ্যমের খবরে জানা গেল তাতে, জন অ্যাশের বিরুদ্ধে ১৩ লাখ ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন নিউ ইয়র্কের প্রসিকিউটররা। ওই অর্থ তিনি নিয়েছিলেন চীনা আবাসন নির্মাতা কোম্পানি এনজি ল্যাপ সেং-কে সরকারি কাজ ‘পাইয়ে দেওয়ার’ মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাটর্নি প্রিট ভারারা বলেছেন, রোলেক্স ঘড়ি, একটি বাস্কেটবল কোর্ট আর দামি স্যুটের বিনিময়ে জন অ্যাশ নিজেকে এবং যে আন্তর্জাতিক সংস্থার তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাকে বিক্রি করে গেছেন।
সবশেষে জাতিসংঘের এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই প্রবাদ বাক্যটিই মনে পড়ে যায়-এ যেন এক দন্তহীন বাঘ।
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, গবেষক ও কলাম লেখক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com