ছোট বেলার দিনগুলো সবারই অনেক সুন্দর থাকে। আর সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে, তখনকার কথা শুনতে কিংবা পড়তে কার না ভালো লাগে!
আজ সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডি ওপেন করতেই একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। ছবিটি আমাকে এতটা আবেগপ্রবণ করে তোলে যে- মুহূর্তেই ফিরে যাই সেই দূর-অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোতে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাই এক অন্যরকম মনোজগতে। আমার সেই ছোটবেলার সবকিছু মনে করিয়ে দেয়। তাই আমার আজকের বিষয় সেই ছবি আর আমার ছেলেবেলা কথা নিয়েই।
সুপ্রিয় পাঠক, যে ছবিটি আজ আমাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে সেটির কথা দিয়েই শুরু করবো। তবে এর আগে নিজগ্রামের কিছু কথা বলি। আমার জন্ম ময়মনসিংহ ত্রিশালের অজপাড়া গাঁ বীররামপুরে। গ্রামটি আধুনিকতার ছুঁয়া না পেলেও এর সৌন্দর্য কিন্তু মোটেও কম ছিল না। নদী-খাল-বিল আর গাছগাছালি ঘেরা ধান ধন্যে পুষ্পেভরা পাখির কলরবে নিকানো উঠানে সুন্দর এক-দু’চালা মাটির আর টিনঘেরা বাড়ির গ্রাম। সবুজ ছায়া ঘেরা সারাক্ষণ সরব পাখির কলতানে। ওখানেই কাটে আমার ছেলেবলা।
থাক এসব কথা, এবার আসি আজ সকালের ফেসবুকের সেই ছবি আর ছেলাবেলার কথায়। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন তরুণী সুপারি গাছের ডাল (খোল) দিয়ে তৈরী গাড়ীতে ২-৩ বছরের এক শিশুকে চড়িয়ে টানছে, শিশুটি পরম সুখ আর আনন্দে হাসিমুখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী সুখ, কী আনন্দ! আর এ দৃশ্যটি দেখেই আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই ফেলে আসা ছেলেবেলার দিনগুলোতে।
সুপ্রিয় পাঠক, আমরা যারা গ্রামে জন্ম নিয়েছি, তারা সবাই কমবেশি জানি- গ্রামীন কচি কাঁচাদের বিনোদনের অন্যতম উপকরণ হলো এই সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি গাড়ী। এতে চড়ে একে অপরকে টেনে টেনে খেলা করা। এক্ষেত্রে আমার জীবনেও এর ব্যত্যয় হয়নি। সেই ছোট বেলায় তো আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম। কি কি যে করেছি তা বলতে আর শৈশবের কিছু কিছু ঘটনা মনে পড়লে তো এখনো হাসি পায়।
আমার বাপ-চাচারা তিন ভাই। সবার বসবাস ছিল একই বাড়িতে। আমরা চাচাতো-জেঠাতো ভাইবোন মিলে প্রায় ১৫-২০ জন। আগেই হয়তো অন্য আরেকটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম- আমাদের বাড়িটি ছিল কয়েক একর জমির উপর।খেলাধূলা করার জন্য আলাদা কোনো মাঠে যেতে হতো না। বাড়ির ভেতর-বাইরের উঠোন ছিল বিশাল। সেখানেই আমরা খেলা করতাম।
বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে যা শুনেছি এবং যতদূর স্মরণে পড়ে তাতে, জন্মের পর যখনও ভালভাবে হাঁটতে কিংবা দৌড়াদৌড়ি করতে শেখেনি সেই সময় থেকেই সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি গাড়ীতে চড়া শুরু।
এরমধ্য দিয়েই খেলাধূলার জগতে প্রবেশ আমাদের। আমার বড় ভাই-বোনেরা একত্র হলে এখন্ও গল্প করেন- ছোটকালে আমি নাকি খুব খুমারি ও দুষ্টু ছিলাম। সারাক্ষণ নাকি আমাকে এই সুপারি গাছের খোলের গাড়ীতে চড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে হতো। মা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে, কোথাও গেলে কিংবা আমি বেশি কান্নাকাটি করলে নাকি এই গাড়িতে চড়ালেই সব ঠিকঠাক হয়ে যেত।
এছাড়া একটু বড় হবার পর এ খেলা নিয়ে ভাইবোনদের সাথে মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাটিতেও লিপ্ত হতাম।এ খেলার সুবাদে সুপারিগাছ ও এর খোল আমাদের সবার কাছে খুব প্রিয় ছিল।এজন্য সেই ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠেই আমরা সুপারিগাছের বাগানে যেতাম। ভাইবোনদের মধ্যে অন্যরকম প্রতিযোগিতা, কে কার আগে গিয়ে সেই খোল ধরতে পারে!
এ জন্য অনেক সময় ফজরের আজানের আগেও চাচাতো ভাইবোনদের সাথে দেখা মিলতো সুপারিগাছের বাগানে।এরপর সকাল হতেই সেই খোলের গাড়িতে চড়ার খেলা শুরু, চলতো স্কুলে যাবার আগ পর্যন্ত। এভাবে সুপারিগাছের খোল নিয়ে কত যে খেলা করেছি এর কোনো ইয়ত্তা নেই।
শুধু এ খেলা কেন, ভাইবোনদের সাথে খেলেছি গোল্লাছুঁট, রশিটানাটানি (কাঁচি টান), কুতকুত, পুতুল, লাফ, পাইত-পাইত, ষোলগুটি, সাতচারা, দড়িলাফ, লুডু, ছোয়াছুয়ি, কানামাছি, লুকোচুরি, বুলবুলি, শাক-ভাত, চোর-ডাকাত-পুলিশ, সেটমিলানো, মার্বেল, লাটিম, ঘুড়ি ওড়ানো, কেরাম, ফুটবল, দাবা, কাবাডি-হাডুডু, কাগজে কাটাকুটি, হুপখেলা দাড়িয়াবান্ধা ও বউচীসহ আরো কত ধরনের খেলা। খেলার নেশায় সাক্ষারণ মত্ত থাকতাম, এ জন্য দাদী, বাবা-মার কত যে বকাবকি খেতে হয়েছে।
আমার এখনো স্মরণে আছে সেই প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময়কার কথা- একদিন স্কুল থেকে আসার পর বাবা আমাদের দুই ভাইকে বললেন, নদীর পাড়ে মাঠে বাঁধা খাসি (ছাগল) দুটি সন্ধ্যায় আনতে হবে। কিন্তু কাউকে কোনো কিছু না বলে আমরা দুইভাই মুচিরবাড়ি থেকে কুকুরের বাচ্চা আনতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখি দুটি খাসিই শেয়াল মেরে ফেলেছে। এতে মা কাঁদছেন। সুপ্রিয় পাঠক বুঝতেই পারছেন বাবা বাড়িতে আসলে আমাদের দশা কী হতে পারে! তাই ভয়ে বাড়ি ছেড়ে নানা বাড়িতে লুকিয়েছিলাম।
ওইসব আজ আমাদের অতীত হলেও মনের ক্যানভাসে আনন্দের ঢেউ তোলে। তাই তো আজ সকালে ফেসবুকে সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি গাড়ী দেখে ফিরে গিয়েছিলাম অতীতের সেই ছোটবেলায়।
এখানকার শিশুদের কাছে আমাদের এসব খেলার গল্প অনেকটােই ভৌতিক মনে হতে পারে। কেননা, আজকালকার শিশুদের খেলাধূলার সুযোগ নেই। খেলাধূলা করার জন্য যতটুকু সময়-জায়গা দরকার তাও নেই। সারাক্ষণ লেখাপড়ার চাপ, কী স্কুলে কী বাড়িতে! আর জনসংখ্যার চাপে আগেকার মাঠগুলোও হারিয়ে গেছে।
স্কুল কিংবা বাড়ির আঙিনায় সামান্য জায়গা থাকলেও তা কাঁদা-পানি-বালিতে খেলাধূলার অনুপেোগী। শহরগুলোতে নেই শিশুদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ। শুধু শহরে কেন গ্রামেও নেই সেটা, আমরা ছেলেবেলায় খেলাধূলা ও হাসি-আনন্দে যেভাবে জীবন কাটিয়েছি তা আজকালকার শিশুদের কাছে রূপকথার গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজকালকার শিশুদের ঠেলে দেয়া হয়েছে এক অশুভ প্রতিযোগিতায়।তাই শুধুই পড়া ছাড়া অন্য কোনো পথ তাদের কাছে অমূলক।তাই তো শিশুরাও খেলতে ঘরে বাইরে বের হয় না, অভিভাবকরাও এতে আগ্রহী নন। শহরজুড়ে শিশুদের পোশাক, খেলনার দোকান, পার্ক, স্কুল, গাননাচ শেখার কোচিং থাকলেও প্রকৃত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই।
ফলে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য সুযোগ নেই। শিশু সুলভ নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া বা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ নেই শিশুর। যা শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশে বাধা দেয়।এতে যা হবার তাই হচ্ছে।
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, গবেষক ও কলাম লেখক, ই-মেইল: sarderanis@gmail.com