আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে অনলাইনে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতেই একটি সংবাদে চোখ আটকে যায়।সংবাদটির শিরোনাম পড়েই মন ফুঁড়ফুড়ে।এ যেন এক বিস্ময়কর নতুন কিছু দেখছি!সংবাদটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ’।
সংবাদটি বারবার পড়ার চেষ্টা করি।যতই পড়ছিলাম ততই মন পুলকিত হয়ে উঠছিল।তাই কোনো বিরতি ছাড়াই মনোযোগ দিয়ে একনজরে সংবাদটি পড়ি।কেননা, এমন ভালো সংবাদ আমার জীবনে এর আগে আর কখনও পড়েছি বলে স্মরণে পড়ছে না।
সংবাদটি পড়ে যেমন মনে আনন্দ জাগছিল।তেমনি ভাবছিলাম আমি কি ঘুম থেকে উঠেছি, না নতুন কোনো জনপদে পুনর্জন্ম নিয়েছি।সংবাদটির সারবস্তু নিজের অবস্থানকে বারবার সন্দেহের দোলা দিচ্ছিল।সত্যই আমি এতই পুলকিত হই যে, আমার অবস্থান পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গায় তা ভেবে পাচ্ছিলাম না!
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক জনমত জরিপ সম্পর্কিত সংস্থা গ্যালাপ-এর বরাদ দিয়ে সংবাদটি সরবরাহ করেছে বাংলাদেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা (বাসস)।এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সসহ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশ বেশি নিরাপদ।এশিয়ার অনেক প্রতিবেশি দেশ আমাদের দ্বারে কাছেও নেই।বাংলাদেশ বিশ্বের নিরাপদ দেশ হিসেবে ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার উপরে অবস্থান করছে।
এতে বলা হয়, ২০১৪ সালে বিশ্বের ১৪১ দেশের ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করে গ্যালাপ।এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ৩টি প্রশ্ন ছিল- ১. পুলিশের উপর আস্থা, ২. রাতে চলাফেরা ও ৩. চুরি বা ডাকাতির ঘটনা। এই ৩ প্রশ্নের জবাবের ভিত্তিতে গ্যালাপের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন-২০১৫ প্রণীত হয়।যা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সত্যিই এমন সংবাদ আত্মস্লাগার।
যাই হোক, সংবাদটি আগাগোড়া পড়ে ফুঁড়ফুড়ে মেজাজে ঘর থেকে রাস্তায় বের হলাম।বের হয়েই দেখি সত্যিই তো দেশ পাল্টে গেছে!রাস্তার দুই দ্বারে অস্ত্র তাক করে সারি সারি র্যা ব পুলিশ মোতায়েন।আরেকটু এগিয়ে দেখি ওভারব্রীজ ও ফ্লাইওভারের উপরে থেকে ভিডিও করা হচ্ছে।আরো কিছুদূর গিয়ে দেখলাম ডগ স্কোয়ার্ড নিয়ে মহড়া দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী।কোথাও কোথাও পথচারীদের তল্লাসি করা হচ্ছে, আবার কোথাও গাড়ি থামিয়ে তল্লাসি চলছে।একটু পরপর র্যা ব-পুলিশের গাড়ি শ শ শব্দে চক্কর দিচ্ছে।সত্যিই দেশটি যেন নিরাপত্তার চাদরে অন্যরকম স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
কিসের মর্নিংওয়াক এগুলো দেখেই আমার আজকের সকাল কেটেছে বেশ ফুড়ফুড়ে মেজাজে।সত্যিই কেমন জানি মনে হচ্ছিল আমি আজ এক নতুন জনপদে নতুন করে জন্ম নিয়েছি।এই ভেবে মনে মনে বলছিলাম যাক বাঁচা গেল, আমার দেশ পাল্টে গেছে।এখন থেকে আর কাউকে রাস্তাঘাটে দুর্বৃত্তের গুলিতে মরতে হবে না, কোনো ছিনতাই-রাহাজানির ঘটনার শিকার হতে হবে না।সন্ত্রাসীর গুলিতে আর কোনো নাগরিককে রাস্তাঘাটে প্রাণ দিতে হবে না। আর কোনো অপরাধের ঘটনার সংবাদ আমাদের শুনতে হবে না।এমন ভাবতে ভাবতে রাস্তায় হাঁটছিলাম।
আমার এমন স্বপ্ন বেশিক্ষণ টেকেনি।মোবাইল ফোনে অনলাইন পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম।হঠাৎ চোখে সামনে ভেসে আসে দিনাজপুরে দুর্বৃত্তের গুলিতে ইতালীয় নাগরিক গুলিবিদ্ধ। স্বেচ্ছাসেবী বিদেশী সংস্থার ওই ইতালিয় নাগরিক ড. পিয়রো সকালে মর্নিংওয়াকিং করতে বের হয়েছিলেন।শহরের মূলকেন্দ্রেই তাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।শুনেছি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে।
এর কিছুসময় পর বেলা সাড়ে এগারটিকে খবর পেলাম মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রধান বিরোধী জোটের দুই নেতাকে ফাঁসির চূড়ান্ত রায় হয়েছে।এ নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক তোলপাড়।টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে চলছে অন্যরকম উৎসবের আমেজ। অনেকেই আদালত চত্বর থেকে লাইভ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন, আবার অনেকে স্টুডিওতে বসেই ভাষ্য দিচ্ছেন।এ এক অন্যরকম দৃশ্য!
এর কিছুক্ষণ পর টেলিভিশনের পর্দায় দেখি এই ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আগামী বৃহস্পতিবার সারাদেশে হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামি।পরিস্থিতি এমন যে সবার তৎপরতায় হরতালের আগেই যেন হরতাল শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এমন এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেন দেশে এক যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।
এরকিছুক্ষণ পর শোনি ফেসবুক, ওয়ার্টসপ, ভাইবারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।ইন্টারনেটও সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে বিটিআরসি।
জানিনা, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক জনমত জরিপ সম্পর্কিত সংস্থা গ্যালাপ- কাদের দেয়া কোন তথ্যের ভিত্তিতে এমন একটি জরিপ প্রতিবেদন করেছে।আর সংবাদ সংস্থা বাসসের সরবরাহ করায় সেই সন্দেহ আরো বেশি।যাক, এর বাস্তবতা সুপ্রিয় পাঠকরাই বিবেচনা করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
সকালের সেই বিভোর স্বপ্ন আমার দুপুরের মধ্যেই ভেঙ্গে গেল।তাই আজ আমাকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বিশ্বের সেই নিরাপদ জনপদ থেকে বলছি- যেখানে সকাল-বিকাল দেশি-বিদেশি নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর হাতে, যার কোনো প্রতিকার নেই।
যেখানে ক্রসফায়ার আর বন্দুকযুদ্ধের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিনাবিচারে প্রতিনিয়ত নাগরিক হত্যা করছে, যেখানে প্রকাশ্যে দিবালোকে মা-বোনদের সম্ভ্রত হরণ করা হয়, নারী-শিশু নির্যাতনের পর ভিডিও প্রকাশ করা হয় ভার্চুয়াল জগতে, যেখানে মুক্তচিন্তার লোকদের ধারাবাহিকভাবে হত্যা করা হয় বিচার হয় না, যেখানে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারের সঙ্গে মিলে গড়া হয়েছে এক অভিনব শাসন, যেখানে বিরোধীদের দমনের নামে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।যেখানে বিচার নামে চলে প্রহসন। হায়রে নিরাপত্তা, হায়রে গণতন্ত্র! তোমার মতো এমনটি আর কোথায় পাবো!
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, গবেষক ও কলাম লেখক । ই-মেইল: sarderanis@gmail.com