শীর্ষবিন্দু নিউজ: আবারও ভেঙে গেলো তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। শনিবার দলের কাউন্সিল অধিবেশনে নেতাদের মতবিরোধ হওয়ায় পৃথক কমিটি গঠনের ঘোষণা এসেছে। এতে কার্যত দুই অংশে ভাগ হয়ে গেলো দলটি।
জাতীয় কাউন্সিলে সংসদ সদস্য শিরিন আক্তারকে সাধারণ সম্পাদক করার বিরোধিতা করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ থেকে বেরিয়ে আলাদা কমিটি ঘোষণা করেছে দলটির একটি অংশ। সুষ্ঠুভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হচ্ছে না অভিযোগ করে দলের নির্বাচনী অধিবেশন থেকে শনিবার রাত ১০টার দিকে বেরিয়ে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি ও সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক করে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবে ঘোষিত এই কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি করা হয়েছে সংসদ সদস্য মাইনুদ্দিন খান বাদলকে, যিনি আগের কমিটির কার্যকরী সদস্য। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া ।
এই কমিটি ঘোষণার প্রায় ৩ ঘণ্টা পর মহানগর নাট্যমঞ্চে চলমান নির্বাচনী অধিবেশনে হাসানুল হক ইনুকে সভাপতি এবং শিরিন আক্তারকে সাধারণ সম্পাদক করে জাসদের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ছয় বছর পর এবার সম্মেলন করেছে সরকারের শরিক এই দলটি। শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাসদের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন হয়। শনিবার বিকালে মহানগর নাট্যমঞ্চে শুরু হয় জাসদের নির্বাচনী অধিবেশন।
নতুন কমিটি ঘোষণার বিষয়ে শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, নির্বাচনী অধিবেশন সুষ্ঠুভাবে হয়নি বলে আমরা এ কমিটি ঘোষণা করেছি। দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য তাদের সঙ্গে রয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করা হবে।
আম্বিয়ার অভিযোগ, নির্বাচনী অধিবেশনে ব্যালটের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের আহ্বান জানানোয় তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়েছে। আমরা ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন চেয়েছি। কিন্তু ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন দেওয়া হয়নি। এমনকি আমাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। অধিবেশন থেকে বের করে দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মাইনুদ্দিন খান বাদল ও তার পক্ষের নেতাকর্মীরা বলেন, তারা ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা বললেও কণ্ঠভোটে হাসানুল হক ইনুকে সভাপতি এবং সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক সাংসদ শিরিন আক্তারকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। রাত ১১টার দিকে শিরিন আক্তার দাবি করেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে; ফলাফল ঘোষণা হবে আরও পরে। এরপর রাত দেড়টার দিকে নতুন কমিটি ঘোষণার কথা জানান শিরিন আক্তারের ব্যক্তিগত সহকারী শাহিনা পারভিন বাবলি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তাদের কথিত তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা ছিল জাসদের। এ লক্ষ্যে গণবাহিনী নামে তাদের সামরিক শাখাও তৈরি হয়। সেই গণবাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনীতিবহির্ভূত সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে গৃহবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন গণবাহিনীর সামরিক অধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের। পরবর্তীতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের নামে কর্নেল তাহেরকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আদালতের এক রায়ে একে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে এর জন্য জেনারেল জিয়াকে দায়ী করা হয়।
জিয়ার শাসনামলে জাসদ দুইবার ভাঙে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বেরিয়ে আলাদা জাসদ গঠন করেন। এরপর বেরিয়ে গিয়ে বাসদ গঠন করেন খালেকুজ্জামান ও আ ফ ম মাহবুবুল হক। সেই বাসদ এখন খণ্ড খণ্ড হয়ে টিকে আছে। আশির দশকে আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সময়ে জাসদ আবার ভাঙে। এক সময়ের ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ আলাদা আলাদা জাসদ গঠন করেন। মাইনুদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বেও আরেকটি জাসদ হয় সে সময়।
রব সামরিক শাসক এরশাদের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে ১৯৮৮ সালের সব দলের বর্জন করা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হন। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে শাহজাহান সিরাজ বিএনপিতে যোগ দেন; পরে বাদল ফিরে যান ইনুর জাসদে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের সরকারে মন্ত্রী হন রব। তবে ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় আওয়ামী লীগের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে এরশাদ ও কাদের সিদ্দিকীসহ পুরানো মিত্রদের জোটবদ্ধ করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে এমপি হওয়ার পর সরকারের মন্ত্রীও হন ইনু। শিরিন আক্তারকে জাসদের সাধারণ সম্পাদক করার উদ্যোগের মধ্যে দলটির নাম দিয়ে সর্বশেষ এই ভাঙন হলো। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ গঠন হয়েছিল সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দুইবার, এরশাদের শাসনামলে একবার ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। সর্বশেষ জাসদ (ইনু), জাসদ (রব) এই দুই অংশে কার্যক্রম চলছিল দলটির। পাল্টা কমিটি গঠনের মাধ্যমে এখন কার্যত তিন অংশে ভাগ হলো দলটি।