বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৭:৩৭

রেমিট্যান্সের আশায় নারীদের আমরা কোথায় পাঠাচ্ছি

রেমিট্যান্সের আশায় নারীদের আমরা কোথায় পাঠাচ্ছি

স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারে অভাবের কারণে গত বছরের ২৫ জুন সৌদি আরবে যান রংপুরের এক নারী। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানকার গৃহকর্তা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করতেন। বাইরে থেকে আসা পুরুষেরাও নির্যাতন করত। প্রতিবাদ করায় তাঁর গায়ে আগুন দেওয়া হয়। যশোরের এক নারীকে গত বছরের ৫ নভেম্বর সৌদি আরবে পাঠায় ফাতেমা ওভারসিজ নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি।

ওই নারী যে বাসায় কাজ করতেন, সেই বাসার গৃহকর্তা, তাঁর ছেলে ও ছেলের বন্ধুরা তাঁকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছেন। কুমিল্লার এক নারী নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে সৌদি নিয়োগকর্তার কাছে যান। কিন্তু নিয়োগকর্তা তাঁকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন না।

ওপরে যে কটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম, এগুলো সবই আজকের প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রয়েছে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা’। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ ধরনের শিরোনাম আমরা আর কত দিন দেখব। কিছুদিন বিরতির পর পত্রিকাগুলোয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের খবর প্রকাশ পায়।

কিন্তু এসব নির্যাতন প্রতিরোধে বা নির্যাতনের শিকার নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কোনো কোনো ভাগ্যবতী অবশ্য দেশে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু বেশির ভাগেরই কোনো খবর নেই। তাঁরা আদৌ দেশে ফিরতে পারবেন কি না, তা কারও জানা নেই।

সংসারে একটু সচ্ছলতা আসবে। এই আশায় প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার নারী সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির জন্য যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভালো থাকলেও বেশির ভাগই প্রতারণার শিকার হন। যে সচ্ছলতার আশায় তাঁদের এই বিদেশ পাড়ি, সেই সচ্ছলতার মুখ তাঁরা কোনো দিনই দেখতে পান না। গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁদের মূলত দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে।

যাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পান, তাঁদের ওপরও চলে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন। দিনের পর দিন তাঁদের না খাইয়ে রাখা হয়। বেতনও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। প্রতিবাদ করলে মেলে আরও নির্যাতন। অনেকেরই সেখানে বন্দী অবস্থায় দিন কাটছে। কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনেক দিন ধরেই বিষয়টি তুলে ধরছে। নির্যাতনের কারণে ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সবকিছু জানার পরও বাংলাদেশ দুই-তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে গত বছর থেকে নারী কর্মীরা যাচ্ছেন। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।

বোঝা যায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার কারণেই ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনের মতো দেশ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশ নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তারা আগ্রহ প্রকাশ করবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আমাদের নারীদের এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেব? বিশেষ করে এখন যখন আমাদের সামনে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে সে দেশে আমাদের নারীদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্সের আশায় আমরা আমাদের নারীদের কোথায় পাঠাচ্ছি! এই পরিস্থিতিতে সরকারের তরফে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।

তবে শুধু সৌদি আরবই নয়, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননেও বাংলাদেশি নারীরা কাজের জন্য যাচ্ছেন। কিন্তু সেসব দেশেও তাঁদের অবস্থা তথৈবচ। দেশের কয়েক লাখ নারী শ্রমিক বিদেশে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ অপর্যাপ্ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর কাজে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। হয় বিদেশে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্যোগ নিন, নয় তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনুন, আর নয়তো মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিন। দেশের ভেতরে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন, যাতে দুটো পয়সার জন্য তাঁরা বিদেশমুখী না হন।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025