বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৭:৩১

বেচারা ইলিশ

বেচারা ইলিশ

এ কে এম জাকারিয়া: পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে এত প্যাঁচ মনে হয় আগে কখনো লাগেনি। বাংলা বছরের শুরুর দিন অনেকেই পান্তা-ইলিশ খান এবং এটাকে এখন একটা রেওয়াজই বলা যায়।

এবার দেখলাম বেশ জোরেশোরেই পয়লা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে। পান্তা-ইলিশবিরোধী এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে—এ সময় ইলিশ পাওয়া যায় না, তাই জাটকা ধরা হয়। মা-ইলিশ ধরা হলে ভরা মৌসুমে ইলিশ পাওয়া যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

লিশ রক্ষার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে যদি কেউ পান্তা-ইলিশ খাওয়া থেকে দূরে থাকেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অনেকে তো দেখছি মূল ধরেই টানাটানি শুরু করেছেন। তুলছেন সংস্কৃতির প্রশ্ন। বাঙালির বৈশাখ উদ্যাপনের আদিতে নাকি ইলিশ খাওয়ার কোনো চল ছিল না। যাঁরা ইলিশ খাওয়া নিয়ে সংস্কৃতির প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের বলি, ভাই, আদিতে তো কত কিছুই ছিল না।

আর আদিতে যা ছিল না, তা কোনো দিন সংস্কৃতির অংশ হতে পারবে না—এই দিব্যি কে দিয়েছে!

দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন যেভাবে বৈশাখ উদ্যাপনে মাতে, আদিতে কি তেমন হতো?

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছাড়া এখন আমরা পয়লা বৈশাখের কথা ভাবতেও পারি না! এরও তো একটা শুরু ছিল। পরে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বলতেই আমরা বুঝতে শুরু করি বটমূলের এই অনুষ্ঠানটিকে। এখন এর সঙ্গে আরও নানা অনুষ্ঠান ছড়িয়ে পড়েছে শহরজুড়ে। নানা আয়োজনে উৎসব চলে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় এমনকি ফ্ল্যাট কম্পাউন্ডেও। আদির প্রশ্ন তুললে তো এগুলো সবই বাদ দিতে হয়!

মানুষ উৎসব করতে চায়, বৈশাখ সে সুযোগ করে দিয়েছে। যে যেভাবে তা করতে চায় করুক না! কেউ রমনার বটমূলে যাক, কেউ চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিক, কেউ পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাক, কেউ নতুন জামাকাপড় পরে গন্তব্যহীনভাবে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুক, অথবা হাতিরঝিলে গিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি করুক, সমস্যা কী!

কোনো কিছু রেওয়াজ হয়ে গেলে এর সঙ্গে ব্যবসাও দাঁড়িয়ে যায়। এখন বৈশাখ সামনে রেখে নতুন জামাকাপড় বাজারে আসে। লোকজন এখন অনেকটা ঈদের মতোই বৈশাখেও কেনাকাটা করেন। অনেকে এ সময় ইলিশ খাবেন, তাই মাছ ব্যবসায়ীরা তিন-চার মাস আগে থেকেই ইলিশ মজুত করে রাখেন। সুযোগ বুঝে বেশি দামে বিক্রিও করেন। যাঁদের টাকাপয়সা আছে, তাঁরা কিনবেন, খাবেন।

পান্তা-ইলিশের বিরোধিতা করে বড়লোকের খাওয়াদাওয়ায় বাগড়া দেওয়ার কী দরকার পড়ল কে জানে! বড়লোকেরা তো অনেক কিছুই খান, অনেক কিছুই করেন, যা দেশের বেশির ভাগ মানুষ পারেন না। যাঁদের ইলিশ জোগাড়ের সামর্থ্য নেই, তাঁরা ভিন্ন ব্যবস্থা করবেন, পান্তা যদি খেতেই হয়, তবে নতুন কিছুর সঙ্গে খাবেন, একসময় হয়তো সেটাই রেওয়াজে পরিণত হবে। এই যে এবার প্রথম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন, এই রেওয়াজ কি আগে ছিল?

এই যে শুরু হলো, এটাই একসময় রেওয়াজে পরিণত হবে। সামনের বছরগুলোতে হয়তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বৈশাখে উৎসব ভাতা দেবে!

সেদিন দেখলাম ফেসবুকে আমার এক বন্ধু এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, পান্তা যদি খেতেই হয় একাধিক পদের ভর্তা আর কই মাছ দিয়ে খাওয়াই উত্তম। তিনি লিখেছেন, ‘কই মাছ ভেজে মসলা দেওয়া কিংবা সরষে দিয়ে মাখো মাখো ঝোল কিংবা একগাদা সরষের তেল দিয়ে কই—একবার খেয়েই দেখুন, পয়লা বৈশাখে আর কোনো দিন ইলিশের নাম মুখে আনবেন না।’ তিনি নিজের পছন্দের একটি রেসিপিও দিয়েছেন। ‘কালিজিরা

আর কাঁচা মরিচ ফোড়ন দিয়ে হলুদ-মরিচ-ধনের গুঁড়ো দিয়ে সাঁতলে নিয়ে তাতে একটু আদা, রসুন, পেঁয়াজবাটা দিয়ে কই মাছ ছেড়ে দিয়ে একটুখানি কষিয়ে নিয়ে সেগুলো কুমড়া বা লাউপাতায় মুড়ে পাঁচ মিনিট ওভেনে রেখে বের করে পান্তা দিয়ে খেয়ে দেখুন।’ পাঠকদের কেউ কেউ চেষ্টা করে দেখতে পারেন!

কে জানে সামনের দিনগুলোতে পান্তার সঙ্গে কই মাছ খাওয়াটাই রেওয়াজে পরিণত হয় কি না! বিশেষ করে যখন চাষের কই মিলছে কম দামে। পান্তা-কই হলে কি বৈশাখ উদ্যাপনে বড় সমস্যা হবে! কই হোক, ইলিশ হোক বা অন্য কিছুই হোক—উৎসবে শামিল হওয়াই তো বড় কথা। কেউ কেউ হঠাৎ ইলিশ নিয়ে পড়ল কেন কে জানে!

আমাদের দেশে বৈশাখের উৎসব আজ যেখানে এসেছে, লোকজন যেভাবে নেমে পড়েছে, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছে। এটা এখন সব মানুষের জন্য এক মুক্ত উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পান্তার সঙ্গে কে কী খাবে বা ভবিষ্যতে আদৌ কেউ পান্তা খাবে কি না, সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হবে, আবার বদলাবে। আসুন, আমরা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় আস্থা রাখি। ‘পান্তা-ইলিশ’ এক অহেতুক বিতর্ক। বেচারা ইলিশকে এ থেকে মুক্তি দিই!




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025