আহমেদ জামাল: রাজনৈতিক প্রশাসনিক চাপে থেকেও সক্রিয় হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। অসুস্থতা কাটিয়ে আবারও মাঠে নেমেছেন সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। ইফতার মাহফিলের মতো ঘরোয়া কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। সংগঠিত করছেন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের।
ভয়ভীতি কাটিয়ে ঈমানি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতায় ঢাকায় হেফাজতের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হলেও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য জায়গায় থেমে নেই তারা। বিশেষ করে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর মুক্তি ও সুস্থতার মধ্য দিয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থার বাড়তি দৃষ্টি আরও উজ্জীবিত করছে তাদের। ইফতার মাহফিল ও পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে তারা। ঈদের পর আঞ্চলিক পর্যায়ে শানে রেসালাতের মাধ্যমে নতুন করে জেগে ওঠার পরিকল্পনা নিচ্ছেন দায়িত্বশীলরা। এর ধারাবাহিকতায় ৮ই জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মহাসচিব বাবুনগরীর সম্মানে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সংবর্ধনা সভা। শাপলা অপারেশনের পর এটাই হচ্ছে সংগঠনটির প্রকাশ্য বড় সমাবেশ।
সমাবেশে মহাসচিব বাবুনগরী বলেন, সরকার দেশের আলেম ওলামাদের উৎখাতে ব্যর্থ হয়েছে। নাস্তিকদের পক্ষ নিয়ে তারা ধর্মপ্রাণ মানুষের সমর্থন হারিয়েছে। তাই এখন তাদের মনে জ্বালা ধরেছে। সেই জ্বালা মেটাতে না পেরে হেফাজতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কখনও ক্ষমতার অংশ হতে চায় না। আমরা কাউকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে ও নামাতে চাই না। তবে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদ ও ঈমান-আকিদা বিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে হেফাজতে ইসলাম কখনও আপস করবে না। এতে যদি কারও আঁতে ঘা লাগে তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।’ কারাভোগ, জামিনে মুক্তি সবশেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর সেদিন প্রথম বারের মতো প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন বাবুনগরী। এ সময় তাকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে।
জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত হওয়ার পর আমাকে জেলে পাঠিয়েছে সরকারের লোকজন। একের পর এক মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। তবে আমি কখনওই একটু ক্ষণের জন্যও নিজের ঈমান থেকে সরে যাইনি। হক্কানী উলামায়ে কেরামকে আল্লাহ্ যে সম্মান দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর গদির চেয়েও কোটি গুণ মর্যাদার।’ ওদিকে অরাজনৈতিক হয়েও সংগঠনটির রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠায় নেতা-কর্মীদের মনোবল আগের চেয়ে এখন অনেক চাঙ্গা।
সম্প্রতি ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে হেফাজতের ভোটের প্রভাবের ঘটনায় নেতা-কর্মী সমর্থকরা উজ্জীবিত। এছাড়া হেফাজতের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সমঝোতার চেষ্টা, বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে হেফাজতকে আসন দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাবের বিষয়টি, হেফাজতের নেতা-কর্মীদের মনোবলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাহলেও সমপ্রতি সরকার আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণে তাদের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের আশা অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছে সংগঠনটি। হেফাজত আমীরের যে ভিডিও চিত্রের বক্তব্য নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে কড়া সমালোচনা করা হচ্ছে তাকে সমঝোতার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরিকল্পিত অপপ্রচার হিসেবেই দেখছেন নেতা-কর্মীরা। পাল্টা বক্তব্যের মাধ্যমেই ভিডিও ইস্যু মোকবিলা করার চিন্তা করছে সংগঠনটি। ঈদের পরে নতুনভাবে কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। আগের মতোই ওলামা সম্মেলনের মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হতে পারে।
হেফাজত নেতারা বলছেন, ১৩ দফা দাবি এই সরকার বাস্তবায়ন করবে- এমন আশা এখন আর কেউ করছে না। তারা বলছেন, ৫ই মে শাপলা চত্বরে অভিযানের পরই এটা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারপরও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত থাকায় কেউ কেউ কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছিলেন। কিন্তু ৫ সিটি নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকার হঠাৎ সরাসরি হেফাজত বিরোধী অবস্থানে চলে যায়। নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধের কথা সামনে আনা হয়। নির্বাচন কমিশনেও এ নিয়ে কথা হয়। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আল্লামা আহমদ শফীর একটি ভিডিও চিত্র ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এ নিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় রিপোর্ট হতে থাকে। এক পর্যায়ে জাতীয় সংসদে এ নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় লিপ্ত হন সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রথম বারের মতো আল্লামা শফীর কড়া সমালোচনা করে এ নিয়ে কথা বলেন।
হেফাজত নেতারা মনে করছেন, রাজনৈতিক সংগঠন না হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিতে বিশেষ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের ব্যালটের প্রতিবাদ থেকেই হেফাজতের ১৩ দফার প্রতি জনমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সরকারি দল দাবির প্রতি তোয়াক্কা না করে হেফাজতকে দমনের লক্ষ্যে ৫ই মে শাপলা চত্বরে যে অভিযান চালিয়েছে তা যে অন্যায় অগ্রহণযোগ্য সেটাও প্রমাণিত হয়েছে এর মাধ্যমে। নেতারা জানান, ৫ই মে ঢাকা অবরোধের আগে অবরোধ প্রত্যাহার করার শর্তে হেফাজতকে নির্বাচনে ৫০টি আসন দেয়ার প্রস্তাব সরকারি পক্ষ থেকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হেফাজত দাবি আদায়ের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করছে না জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ৫ই মে’র পরও সরকারি মহল হেফাজতকে ম্যানেজ করতে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। তবে আপাতত ইফতার আলোচনার মধ্যেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আল্লামা শফী। তিনি ওমরাহ্ পালন শেষে দেশে ফিরে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।
আল্লামা শফীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ওয়াজের ভিডিও নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বিষয়টি অবহিত করার পর আল্লামা শফীর প্রথম মন্তব্য ছিল- ‘কোন কাজ হবে না, কোন কাজ হবে না, তাদেরই ক্ষতি হবে।’ ভিডিওটির নিজের না অন্যের সে ব্যাপারে কোন মন্তব্য না করেই তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘নারী বিরোধী বক্তব্য আমি কখনও দিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগে জেনা-ব্যভিচার কিভাবে বেড়ে যাচ্ছে সেসব বিষয়ে কথা বলি সব সময়।’ হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুুনগরী বলেন, জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে ঈমানী আন্দোলনকে দমন করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। শাপলা চত্বরে হামলা চালিয়ে হেফাজতকে শেষ করে দেয়া যাবে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা সরকারের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে ইতিমধ্যেই তারা বুঝতে পেরেছে। তিনি বলেন, আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে যেভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাতে উনার কোন ক্ষতি হবে না, হেফাজতেরও কোন ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের। নাস্তিকরা মহানবী (সাঃ) ও ইসলামকে কটাক্ষ করার পর তাদের শাস্তি দাবি করায় তারা আগেও আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু তা কেউ গ্রহণ করেনি। এখনও যারাই নাস্তিকদের পথ অনুসরণ করে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা মানুষ গ্রহণ করবে না।
ঈদের পর আলোচনা করে কর্মসূচি দেয়া হবে জানিয়ে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, হেফাজত আগেও কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়ায়নি ভবিষ্যতেও জড়ানোর ইচ্ছা নেই। তবে হেফাজতকে যারা সমর্থন করে যাবে, দাবির প্রতি সমর্থন জানাবে হেফাজত অবশ্যই তাদের সঙ্গে থাকবে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, নানাভাবে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার এখন অপ্রপচারে নেমেছে। হেফাজত আমীরের চরিত্র হননের চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, সরকারে মন্ত্রী, মহাজোটের এমপি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা হাটহাজারী গিয়ে দফায় দফায় আল্লামা শফীর সঙ্গে দেখা করে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে ৫ই মে ঢাকা অবরোধের আগে কিছু দাবি মানার ব্যাপারে মৌখিক আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। অবরোধের আগে হেফাজতকে ৫০টি আসন দেয়ার বিষয়ে তৃতীয় মাধ্যমে প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন না হওয়ায় এবং দাবির ব্যাপারে আপসহীন হওয়ার কারণে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এসব কারণেই সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে।
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, অপপ্রচারের জবাব আমরা দিচ্ছি। আশা করছি রমজানের পর আমরা কর্মসূচিতে যাবো। তিনি বলেন, হেফাজতের ওপর সরকার যে অত্যাচার চালিয়েছে সিটি নির্বাচনে জনগণ তার জবাব দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে মানুষ আরও কঠিনভাবে জবাব দেবে। হেফাজত যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে। জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ঈমানী শক্তি আরও বেড়েছে।
Leave a Reply