তামীম রায়হান: শুধুই আল্লাহ্র নামে আল্লাহ্র দেওয়া দানে ধন্য হয়ে পরস্পরে মিলে অনাবিল আনন্দ প্রকাশের এক অপূর্ব উৎসব আমাদের ঈদুল ফিতর। পুরো রমজানজুড়ে একমাস সংযমী থেকে পরিশুদ্ধ হৃদয়ে কলুষমুক্ত সমাজের অঙ্গীকারে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরার এমন আবেগ আর কে দিয়েছে আমাদের?
এ মহিমান্বিত খুশরি দিনটিকে বরণ করে নেয়ার জন্য রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মনীতি। ঈদকে সত্যিকার অর্থে পরম করুণাময়ের কাছে গৃহীত করতে চাইলে এ বিষয়গুলোও মনে রাখা প্রয়োজন-
ঈদের দিন যেন কেউ কোন প্রকার রোযা না রাখে। কারণ এটি আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত পবিত্র উৎসব ঈদের সাথে চরম ধৃষ্টতা এবং আল্লাহ্র নেয়ামত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার শামিল। এ বিষয়ে বুখারী শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস-সালাম এর পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিষেধ রয়েছে।
ঈদের দিনটি তো আল্লাহ্ পাকেরই দান। তাই এ দিন বেশি বেশি ‘তাকবীর’ পাঠ করে তাকে ডাকার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পায় প্রকৃত মুমিন। ঈদের নামাজের জন্য রওয়ানা হওয়ার সময় এবং নামাজের অপেক্ষার সময়গুলোতেও এ ‘তাকবীরে তাশরীক’ পাঠ করতে থাকুন। রাস্তাঘাটে যাওয়ার সময় উচ্চশব্দে ‘তাকবীর’ দনি।
তবে এর আগে পরিষ্কার ভাবে গোসল করে পবিত্র হওয়া এবং নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুন্দর পোষাকটি পরিধান করা উচৎি। নিজের এবং নিজেদের চারপাশের সবকিছুকে সুন্দর করে সাজানো ও সুগন্ধিময় করে রাখাও ইসলামী নির্দেশনার অর্ন্তভুক্ত । এসব বিষয়ে এ দিন কোনো ধরণের কৃপণতা কিংবা উদাসীনতা কাম্য নয়। আল্লাহ্ পাক আপনাকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন এবং যে ধন সম্পদ আপনাকে দিয়ে সম্মানিত করেছেন সেগুলো লুকিয়ে রাখাকে তিনি অপছন্দ করেন।
আল্লাহ্ পাকের বান্দারা তার দেওয়া উৎসবে খুশী হয়ে তার বিধানমতো তারই দান করা সুন্দর পোষাক পরে তার পবিত্র নাম জপতে জপতে তার দরবারে সিজদা অবনত হতে ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে- এমন দৃশ্য আল্লাহ্ পাকের কাছে বড়ই আনন্দময় এবং ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করার বিষয়।
ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে কিছু খেয়ে নেওয়া সুন্নত। বুখারী শরীফে হযরত আনাস রা. এর বর্ণনায় রয়েছে, রাষূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস-সালাম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে ঈদের নামাজের জন্য বের হতেন।
আমাদের দেশিয় খাবার- সেমাই ফিরনীর পাশাপাশি কয়েকটি খেজুরও রাখতে পারেন, তাতে অন্তত এ সুন্নতটিও আদায় হয়ে গেল। মুসনাদে আহমদের এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস-সালাম কিছু না খেয়ে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করতে যেতেন না।
ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাওয়া ভালো। তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে হযরত আলী রা. এর বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, ঈদগাহের দিকে হেঁটে যাওয়া সুন্নত এবং কিছু খেয়ে বের হওয়া সুন্নত।
ঈদগাহে যাওয়া এবং নামাজ শেষে ফেরার সময় ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করা সুন্নত। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং একটু ঘুরে হলেও আরেক রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরা। বুখারী শরীফের বর্ণনায় হযরত জাবের রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস-সালাম ঈদের দিন আসা-যাওয়ার সময় রাস্তা পরিবর্তন করতেন।
ঈদের দিন রাস্তা ঘাটে পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করাও সুন্নত। এতে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয়, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা তৈরী হয়। ঈদ মুবারক, ঈদ আনন্দময় হোক, প্রতিটি প্রহর আপনি সুখী হোন- এ জাতীয় বাক্য বলে একে অপরকে আমরা সম্ভাষণ জানাতে পারি।
পরিবারের সবার ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা ফিতরার টাকা আদায় হয়েছে কিনা, খোঁজ নিন। কারো অনাদায় থাকলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিন। ঈদের নামাজের আগে যেন তা দান করা হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। পরেও আদায় করা যায়, তবে নামাজের আগে আদায় করা উত্তম।
ফিতরার টাকা ছাড়াও গরীব-মিসকিন অসহায়কে দান করুন। নিজের হাতে এবং ছোট বাচ্চাদের হাতে দিয়েও দান করাতে শেখান। এতে তাদের দানশীলতা ও মমতার মানসিকতা গড়ে ওঠবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস-সালাম এর সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন একে অপরকে বলতেন, ‘আল্লাহ আমার এবং আপনার তরফ থেকে এ আনন্দকে কবুল করুন।’ ঈদের দিন এমন আনন্দ ও অনুভূতি প্রকাশ করাও ইসলামের অংশ। তবে এসবের কোনো বিষয়েই যেন আমাদের সীমালঙ্ঘন না হয়, সেদিকে সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ঈদের আনন্দ মানে শুধু খাওয়ার আয়োজন নয়, হাসিমুখে সবার সাথে কুশল বিনিময় করুন। পাড়া-প্রতিবেশি থেকে নিয়ে আত্মীয় স্বজন- সবার সাথে সালাম ও মুআনাকা করুন।
কল্যাণের পথে কোন অপচয় নেই, এ কথা সত্য। তবে ঈদের যাবতীয় আনন্দের সবটুকু যেন হয় আল্লাহ্র দেয়া সীমারেখার ভেতরে, নয়তো উল্টো তা পরম করুণাময়ের নাখোশ হওয়ার কারণ হবে।
আজকাল ঈদের সময়ে অতিআধুনিক তরুণ বন্ধুরা রাস্তা ও রাজপথের মোড়ে কানাফাটানো শব্দযন্ত্র বসিয়ে বিদেশী গানের আয়োজন করে থাকেন, বিষয়টি যে শুধু ইসলামবিরুদ্ধ তা নয়, বরং এতে অন্য অনেক মানুষের ক্ষতিও হয়ে থাকে, নিজেদের হালাল আনন্দের কপালে এমন কালো দাগ বসানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমাদের এ ব্যস্ত জীবনে ঈদের দিন নিজেদের আপনজনদের সাথে মেলামেশার অপূর্ব সুযোগ। তাই শুধুই টিভি-সিনেমা-নাটকে বুঁদ হয়ে না থেকে যে যেখানে আছেন, সবার সাথে দেখা করুন, অসুস্থ কিংবা বয়স্কদের কাছে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিন। বাচ্চাদেরকেও এসব পালনে উৎসাহিত করুন। এটুকু সামাজিক ভালোবাসাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনেকদিন।
সব ধরণের কৃত্রিমতা ও লৌকিকতার মুখোশ ঝেড়ে ফেলে অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠার আহবান জানায় ঈদুল ফিতর। তাই আল্লাহ এবং তার রাসূলের আদর্শের সীমানা ডিঙিয়ে যাতে এর কোন অমর্যাদা না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন আমাদেও সবার।
আপনাদের ঈদ আনন্দময় হোক। ঈদ মুবারক।
লেখক: শিক্ষার্থী, কাতার ইউনিভার্সিটি, দোহা
Leave a Reply