শীর্ষবিন্দু নিউজ: মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমানুষের কবি দিলওয়ার সিলেটবাসীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে চিরবিদায় নিয়েছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। নগরীর দক্ষিণ সুরমাস্থ ভার্তখলায় নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন এবং মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে কবি দিলওয়ারের মরদেহ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। কবি ভক্তরা এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। সিলেটের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতি সংগঠন, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এ সময় কবিকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেই সঙ্গে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। বৃহস্পতিবার বাদ এশা ভার্থখলা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে কবি দিলওয়ারের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে পঞ্চায়েতি কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবি দিলওয়ার চার ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কবি অনেকদিন থেকেই নানা রোগে ভুগছিলেন। কবি দিলওয়ার ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে দুরারোগ্য ব্যাধি টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে আনিসা দিলওয়ার ইহলোক ত্যাগ করেন। ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন গণমানুষের কবি। এরপর তিনি তেমন জনসমক্ষে বের হননি। শেষ বয়সে পুত্র কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মৃত্যু তাকে মর্মাহত করে।
এদিকে গণমানুষের কবি দিলওয়ারের মৃত্যুর খবর শুনে নিহতের ভার্তখলাস্থ বাসভবনে ভিড় জমান সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন কবির অনুসারীরা। এ সময় বাসায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কবির মৃত্যুতে শুধু পরিবারের লোকজনই নয়, কবির শুভাকাঙ্ক্ষিরা কাঁদেন অঝোরে। স্ত্রী আনিসা ও কবি দিলওয়ারের সংসারে জন্ম নেয় ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় ছেলে শাহীন ইবনে দিলওয়ার। এরপর জন্ম নেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। তারপর নাহিদ বিনতে দিলওয়ার, রোজিনা বিনতে দিলওয়ার, সাজিয়া বিনতে দিলওয়ার। সবার ছোট কামরান ইবনে দিলওয়ার।
পঞ্চাশের দশকের শক্তিমান ও নিভৃতচারী এ কবি রাজধানী ঢাকার মোহ ত্যাগ করে সিলেটে চলে গিয়ে নিরলস সাহিত্য সাধনা করতে থাকেন। জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত তিনি সিলেটের মাটি আঁকড়ে ছিলেন। তাঁর সাহিত্য চর্চায় প্রতিষ্ঠিত হয়, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পরিষদ। সংগ্রামী জীবনের অধিকারী কবি দিলওয়ার গ্রিক-রোমান মিথ থেকে শুরু করে প্রাচ্যের নানাবিধ পুরাণকে তৃতীয় দৃষ্টির আলোকে প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতায়। জীবনধর্মী ইতিহাসবোধের কারণে তিনি প্রাগৈতিহাসিক কালকে বার বার টেনে এনেছেন তাঁর কবিতায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ঐক্যতান’, ‘পুবাল হাওয়া, ‘উদ্ভিন্ন উল্লাস’, ‘বাংলা তোমার আমার’, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’, ‘বাংলাদেশ জন্ম না নিলে’ উল্লেখযোগ্য।
কবি দিলওয়ার আর জেগে উঠবেন না। সুরমার তীরের এই কবির কবিতা চিরতরে থেমে গেছে। কবি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এই কবিকে নিয়ে সিলেটবাসীর গর্ব ছিল। অহঙ্কার ছিল সব মানুষের। জীবন সাহাহ্নে এসে অনেকটা নীরবে নিভৃতে অভিমানী কবি চিরবিদায় নিলেন। তার মৃত্যুতে সিলেটে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কোলাহলমুখর সিলেট হঠাৎ যেন থমকে গেল।