এবার ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেমের(ব্যারিস্টার আরমান নামে পরিচিত) স্ত্রীকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বুধবার (৮ জানুয়ারি) জানিয়েছে, নিখোঁজ আরমানের ব্যাপারে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপকে প্রশ্ন করেছিলেন এক ব্রিটিশ সাংবাদিক।
টিউলিপ যেহেতু ব্রিটেনের নাগরিক ও এমপি ছিলেন। তাই ওই সাংবাদিক মনে করেছিলেন, হাসিনার কাছে একটি ফোন করলে আরমান হয়ত মুক্তি পেতে পারেন।
চ্যানেল-৪ এর ওই সাংবাদিকের প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হন টিউলিপ। তিনি পরবর্তীতে তার ক্ষমতা ও প্রশাসনকে দিয়ে আরমানের স্ত্রীকে হেনস্তা করান বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার আরমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে তাকে নিয়ে টিউলিপকে প্রশ্ন করেন ব্রিটিশ এক সাংবাদিক। এর জেরে আরমানের বাসায় অভিযান চালান বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা তার স্ত্রীকে ‘মুখ বন্ধ’ রাখার হুমকি দিয়েছিলেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ব্যারিস্টার আরমান বলেছেন, চ্যানেল-৪ প্রতিবেদনটি প্রচার করার কয়েক ঘণ্টা আগে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আমার বাড়িতে যায়। আমার স্ত্রীকে চুপ থাকতে বলে। বাইরের দেশের কার কার সঙ্গে আমার স্ত্রীর যোগাযোগ আছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে। তাকে এমনভাবে হেনস্তা করে যেন কোনো সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
তারা বলেছেন, গণমাধ্যমে যেন এ বিষয়ে কোনো আলাপ না ওঠে। টিউলিপকে এভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি করার বিষয়কে ভালোভাবে নেয়নি শেখ পরিবার। আরমান বলেন, এই কারণেই তারা প্রশাসন দিয়ে আমার পরিবারকে নতজানু করার চেষ্টা করেছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনার গোপন কারাগারে বন্দী ছিলেন মীর আহমেদ বিন কাসেম। বিনা বিচারে দীর্ঘ আট বছর তাকে ওই গোপন বন্দীশালায় আটক রাখা হয়। হাসিনার পতনের পর গত ৬ আগস্ট সেই অন্ধকার কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি ।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর সকালে লন্ডনে টিউলিপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন চ্যানেল-৪ নিউজের সাংবাদিক।
সে সময় সাংবাদিক টিউলিপকে বলেন, একটি ফোনকলের মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশি নাগরিকত্বপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার আরমানের জন্য বিশাল পরিবর্তন আনতে পারেন।
চ্যানেল-৪ এর সাংবাদিক ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে যান। তাকে ব্যারিস্টার আরমান সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, আপনার একটি ফোন কল অনেক পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
তখন ওই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন টিউলিপ। তিনি তাকে উল্টো জিজ্ঞেস করেন, আরমান কী তার সংসদীয় আসনের কেউ? তিনি কী ব্রিটিশ?
জবাবে সাংবাদিক বলেন, আরমান বাংলাদেশি। তার পরিবার আপনার কাছে একাধিকবার অনুরোধ করেছে কিছু করার জন্য।
তখন টিউলিপ বলেন, আপনি কী জানেন আমি ব্রিটিশ এমপি এবং আমার জন্ম হয়েছে লন্ডনে।
চ্যানেল-৪ এর সাংবাদিক বলেন, কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আপনার গভীর সম্পর্ক আছে। আপনি নিজেই বলেছেন আপনি আওয়ামী সরকারের মুখপাত্র। আপনার খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ওই মুহূর্তে টিউলিপ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনি কী বলতে চান আমি বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ? আমি ব্রিটিশ এমপি। আমাকে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ বলার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
এটি বলে তিনি চলে যেতে থাকেন। তখন ওই সাংবাদিক বলতে থাকেন, আপনি আরমানের ব্যাপারে একটি ফোন দিতে পারবেন না? কেন পারবেন না।
সাংবাদিকের সঙ্গে টিউলিপের আলাপের এই অংশটি ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রচার করে ওই গণমাধ্যমটি।
ব্যারিস্টার আরমানের অভিযোগ হচ্ছে, ওই ফুটেজটি প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগেই তার বাড়িতে অভিযান চালান র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
একডজনের বেশি সশস্ত্র সদস্য আরমানের বাড়িতে প্রবেশ করেন এবং তার স্ত্রীকে বিদেশে যোগাযোগ বন্ধ করার হুমকি দেন।
আরমান বলেন, তারা এমনভাবে চার্জ করছিল যেন তারা একজন সন্ত্রাসীকে খুঁজছে। ২০১৬ সালে জীবনের প্রথম আটক হয়েছিলেন আরমান। তার বাবা বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলের একজন নেতা।
২০২৪ সালে হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের পতনের কয়েক ঘণ্টা পর ৬ আগস্ট মুক্তি পান আরমান। ব্রিটেনে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন সাবেক জামায়াত নেতার এই সন্তান।
হাসিনার গোপন বন্দীশালা ‘আয়না ঘরে’ শত শত বন্দীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। বছরের পর বছর সেখানকার বন্দীরা কোনো আলো-বাতাসের দেখা পাননি। আয়না ঘরের বন্দীজীবন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে উল্লেখ করেছেন ব্যারিস্টার আরমান।
চ্যানেল-৪ নিউজকে সংবাদ সম্প্রচার না করার চাপ দিতেই আরমানের স্ত্রীকে হুমকি দিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে এমনটাই জানিয়েছেন ব্রিটেনে আরমানের আইনজীবী মাইকেল পোলক।
তিনি বলেছেন, ব্রিটেনে একজন সংসদ সদস্যকে ন্যায্যভাবে প্রশ্ন করার ফলে বাংলাদেশে এমন একটি নিরাপত্তা সংস্থার হুমকি সৃষ্টি করা হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে মানুষকে নিখোঁজ করে নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
গত সপ্তাহে লন্ডনে টিউলিপের এমন একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান দিয়েছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। যেটি তিনি আওয়ামী ঘনিষ্ঠ একজন আবাসন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। বর্তমানে হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেটে লেবার এমপিদের জন্য বরাদ্দ বাড়িতেই রয়েছেন টিউলিপ।
এছাড়া লন্ডনের পূর্ব ফিঞ্চলেতে তার আরও একটি বাড়ি রয়েছে। যদিও উপহার পাওয়া ফ্ল্যাটের বিষয়ে ‘কোনো ভুল করেননি’ বলে দাবি করেছেন শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, সোমবার হাসিনাসহ আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
জোরপূর্বক গুমের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছে বিশেষ ওই আদালত। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত নতুন তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে, হাজার হাজার মানুষকে জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত টিউলিপ সিদ্দিকের খালা (শেখ হাসিনা)।
এছাড়া রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে টিউলিপের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শেখ হাসিনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
টিউলিপের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তিনি যোগ্য কিনা- ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারকে এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যারিস্টার আরমান।
হাসিনার বন্দীশালায় অমানসিক নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন তিনি। সেখানে তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আঘাত করা হয়।
চ্যানেল-৪ নিউজের সাংবাদিকের সঙ্গে অমন আচরণের সংবাদ প্রকাশের পর এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়েছেন টিউলিপ।
তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে লেবার পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। কিন্তু মন্তব্য করতে রাজি হননি তারা। টিউলিপও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
আরমানের ব্রিটিশ আইনজীবী মাইকেল পলক বলেছেন, চ্যানেল- ৪ কে যেন ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করতে, সেজন্য তার বাড়িতে ওইদিন র্যাবের সদস্যরা গিয়েছিল। দেখুন, আপনি একজন ব্রিটিশ এমপিকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, এরপরই র্যাবের মতো বাহিনীর কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন। যেটি হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িত।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস টিউলিপ সিদ্দিক এবং তার দল লেবার পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু কেউই কোনো কথা বলেননি।
তবে টিউলিপের এক সহযোগী বলেছেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্যারিস্টার আরমানের বিষয়টি নিয়ে ফরেন অফিসে পত্র পাঠিয়েছিলেন তিনি।
ব্যারিস্টার আরমান লন্ডনে পড়ালেখা করেছেন। ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তার বাবার বিচার চলাকালে তিনি তার আইনজীবীর ভূমিকা পালন করছিলেন। ঠিক তখনই তাকে গুম করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন হলে দীর্ঘ আট বছর পর বাড়ি ফেরেন আরমান।
মুক্ত হাওয়ার পর জানা যায়, আরমানকে এতদিন হাসিনার গোপন কারাগার ‘আয়না ঘর’র রাখা হয়েছিল। ওই সময় দেখা যায়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আরমান এতটাই রুগ্ন হয়ে গেছেন যে তাকে চেনাই যাচ্ছিল না।
২০১৬ সালে গুম হয়েছিলেন মীর আহমেদ বিন কাসেম। জামায়াত নেতা মীর কাসিমের ছেলে আহমেদ বিন কাসেম ব্যারিস্টার আরমান হিসেবেও পরিচিত।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলে দীর্ঘ আট বছর পর বাড়ি ফেরেন তিনি। ওই সময় দেখা যায়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আরমান রুগ্ন হয়ে গেছেন। তাকে চেনাও যাচ্ছিল না।
Leave a Reply