সাঈদ শিপন ও শেখ নাসির হোসেন: দীর্ঘ দিন নীরব থাকার পর শেয়ারবাজারে আবারও সক্রিয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীরা। সরকারের উপর মহলের নির্দেশ এবং অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর আকর্ষণীয় পর্যায়ে থাকায় তারা বিনিয়োগে ফিরে আসছেন।
এরই মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। তাদের বিনিয়োগের কারণেই এক মাসের অধিক সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন ৫০০ কোটি টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে বাজারে। এ সময়ে মূল্য সূচকও বেড়েছে ৫০০ পয়েন্টের মতো।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধারাবাহিক দরপতনে ২০১১ সালের এপ্রিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমে আসে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে। এরপর ওই বছরের জুলাই মাসের কিছুদিন এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও ২০১৩ সালের জুলাই মাসের কিছু দিন ৭০০ থেকে হাজার কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হয়। আর বাকি সময়ের অধিকাংশ দিনই লেনদেন ছিলো ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে।
এ পরিস্থিতিতেই ২০১০ সাল থেকে শেয়ারবাজার নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নড়েচড়ে ওঠে। নির্বাচনের আগে সরকারের হস্তক্ষেপেই ২০১৩ সালের জুলাই মাসে কিছুটা গতি ফিরে আসে বাজারে। এরপর রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে শেয়াবাজারের উপর থেকে কিছুটা চোখ ফিরিয়ে নেয় সরকার। তবে বিএনপি অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে জয়লাভ করে অস্বস্তির শেয়ারবাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে আবারও নজর দিয়েছে সরকার।
সরকারের নির্দেশেই চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিনিয়োগে ফিরে আসেন বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারী। তাদের বিনিয়োগে গতি ফিরে আসে লেনদেনে। ৩০০ কোটির ঘর থেকে লেনদেনের গতি ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার ঘরে। সূচকও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বাজার-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক মাসের লেনদেনের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন। তাদের বিনিয়োগ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে তারল্য (নগদ মুদ্রা) ও আস্থার সংকটের মধ্যে থাকা বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দিয়ে এমন গতি ফেরানো অসম্ভব। সরকারের নির্দেশেই প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে আসছে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, বাজারের যে গতি তাতে বোঝা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে এসেছেন। সরকারও শেয়ারবাজারকে একটি স্থিতিশীল স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করছেন। হয়তো সরকারের নির্দেশেই বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসছেন।
কিছু ছোট কোম্পানির দাম নিয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বাজার বেশ ইতিবাচক রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে মূল্য সংশোধন হলেও তা সঠিকভাবে হচ্ছে না। কিছু ছোট কোম্পানির শেয়ার এখনো অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে। তাই বিনিয়োগকারীদের দেখে-শুনে-বুঝে বিনিয়োগ করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধাপক আবু আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে এসেছেন। সরকারের চাপেও অনেকে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে সরকারকে তাদের বিনিয়োগের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তারা যাতে বাজারে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
এদিকে বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারী কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে দেশে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের মালিকানা রয়েছে এমন একটি শিল্পগ্রুপ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। পাশাপাশি কিছু বড় ব্রোকারেজ হাউজের তত্ত্বাবধানে কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে। এসব গ্রুপের সঙ্গে বাজার-সংশ্লিষ্টরা সম্প্রতি রাজধানীর পাঁচ তারকা একটি হোটেলে একাধিক বৈঠকও করেছেন।
ডিএসই’র সভাপতির আহসানুল ইসলাম টিটুর মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ায় শেয়ারবাজারের প্রতি সরকারের মনোভাব ইতিবাচক। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগ করছেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে।
অন্য একটি সূত্রমতে, অর্থমন্ত্রণালায় থেকে বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও সরকার নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ’র (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফায়েকুজ্জামান বলেন, ‘আইসিবি একটি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব সময়ই অসময়ে পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দিয়ে থাকে। সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে’। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি। প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হন নি বিএসইসির কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী ও আরিফ খান।