নিউজ ডেস্ক: বিএনপির অনেক শীর্ষনেতা পদ হারাতে পারেন বলে জানিয়েছে দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র । সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা, বার্ধক্য, আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তা, আন্দোলনে না গিয়ে নানামুখী সুবিধা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করাসহ বিবিধ অভিযোগে রয়েছে বিএনপির উপরে।
ওই সূত্র আরও জানান, দলের দ্বিতীয় শক্তিধর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দলের বিভিন্ন পদে রদবদল করতে চান বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলের যে নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মকান্ডে খুব একটা কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি, আন্দোলনের নামে যারা গা বাঁচিয়ে চলেছেন, কর্মসূচি দিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে নিজেরাই মাঠের বাইরে আত্মগোপনে ছিলেন, তাঁদের ওপরই আসতে পারে পদ হারানোর এই খড়গ।
এছাড়াও দলের শীর্ষনেতাদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ের আমলনামা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড তারেক রহমান। দলের দুর্দিনে যাঁরা দলের না হয়ে গোপন আঁতাতে গা ভাসিয়ে আন্দোলন থেকে নানামুখী মিথ্যা অজুহাতে নিজেদের পর্দার আড়ালে রেখেছেন, গ্রেফতার থেকে বাঁচার জন্য কখনও বোরকা পরে আদালতে গেছেন, কর্মীদের হোন্ডার পেছনে হেলমেট পরে যারা মুহূর্তের মধ্যে আন্দোলনের মাঠ থেকে সরে গেছেন, তাঁদের নিয়েও ভাবছেন দলের এই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। ফলে তাঁদের বাদ দিয়ে দলের আগামী নেতৃত্বে আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন।
এক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতারা পেতে পারেন নতুন দায়িত্ব। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে যাঁরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন এবং গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে যাঁরা যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, এখনও যাঁরা বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন না তবে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যাঁরা নতুনভাবে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁদেরকেও নজরে রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
তাই ঈদের পর বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলে বাদ পড়ার আশঙ্কায় আছেন এসব নেতা। জানা গেছে, ওই নেতাদের দায়িত্ব খর্ব করা হলেও দলের অন্যান্য কম দায়িত্বশীল পদে তাঁদের বসানো হতে পারে। তবে কাউন্সিলের মাধ্যমেই বিএনপির এ শীর্ষনেতাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে দলটির একটি বিশ্বস্ত সূত্র। ইতোমধ্যে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দল গোছানো ও তৃণমূল সফরের ঘোষণা দিয়েছেন।
সম্প্রতি খালেদা জিয়া গুলশানে নোয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘বিএনপি শেষ হয়ে যায়নি। বিএনপি আছে, থাকবে। বিএনপি কখনও ভাঙবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছি। বিএনপি একটি শক্তিশালী দল ছিল, আছে এবং থাকবে। এ দলে কোনো বিভেদ নেই। দল সচল রাখার জন্য যে কোনো সময় পুনর্গঠন করা যায়। অনেকের বয়স হয়ে গেছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এখন আমরা পুনর্গঠন করছি।’
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপিপ্রধানও চান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ নেতারা স্বেচ্ছায় দল ছেড়ে দিন। তাছাড়া দুর্নীতিসহ নানা কারণে বিতর্কিত নেতাদের প্রতি অনীহা রয়েছে খালেদা জিয়ার। তাই ঈদের পর দল পুনর্গঠনে হাত দিলে স্বেচ্ছায় দল না ছাড়া এবং আন্দোলনের মাঠে বিতর্কিত ওই নেতাদের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
তবে স্বেচ্ছায় দল ছেড়ে দিয়ে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলবেন কি না, তারও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষনেতাদের মধ্যে অনেকেই বাদ পড়বেন বার্ধক্যের কারণে এবং কেউ কেউ বাদ পড়বেন ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা বানানো ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার কারণে।
যদিও তাঁদের রয়েছে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় ও ঐতিহ্য। তাঁদের মধ্যে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সারোয়ারী রহমান, ড. আর এ গনি, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ারদের মতো নেতারা। যাঁরা আন্দোলন সংগ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বয়সের ভারে এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেই বললেই চলে। তবে এঁদের মধ্যে দলে তরিকুল ইসলামের প্রয়োজনীয়তা এখনও অনুভব করছেন দলের হাইকমান্ড।
অপরদিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিদেশে মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে থাকায় বাদ পড়তে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। এছাড়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে। এদিকে দলটির ১৭ ভাইস চেয়ারম্যানের কর্মকান্ড নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক।
দলের ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি অনেকেই রয়েছেন সম্পূর্ণ দলীয় কর্মকান্ড’র বাইরে। কেউ বা অসুস্থতার কথা বলে রয়েছেন রাজনীতি থেকে দূরে, কেউ বা আছেন দেশের বাইরে, আবার কয়েকজন আছেন কারাগারে।
তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এঁদের মধ্যে শমসের মবিন চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, বেগম সেলিমা রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন ও নাজিমউদ্দিন আলমের দলের ভেতরে-বাইরে রয়েছে গ্রহণযোগ্যতা। তাই এঁরা আছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুদৃষ্টিতে।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের ৩৬ সদস্যের মধ্যে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) সাঈদ ইস্কান্দার মারা গেছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বাদ পড়ছেন হারুনার রশিদ খান মুন্নু, উকিল আবদুস সাত্তার। বাকি আরও ৩২ জন উপদেষ্টার মধ্যে অনেকে নামেই কেবল পদ ধরে রেখেছেন, কার্যত কোনো ধরনের দলীয় কর্মসূচিতে না থেকে।
চেয়ারপারসনের সক্রিয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শামসুজ্জামান দুদু, রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুক, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবদীন ফারুক, আবদুল মান্নান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু প্রমুখ।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ নেতাদের নেত্রীর পাশাপাশি থেকে দলীয় কর্মকান্ড অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে যে কেউ পেতে পারেন বড় ধরনের মূল্যায়ন। এছাড়া দলীয় কর্মকান্ড অনেকেই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখলেও তাঁদের কার্যক্রমে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন চেয়ারপারসন।
সূত্রমতে, শীর্ষ নেতাদের এমনসব কর্মকান্ডে দলের প্রধান খালেদা জিয়া এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড তারেক রহমান এ নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে পারেন। ফলে দলের শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘদিনের পদ ধরে রাখা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দলের নেতৃত্ব পরিবর্তন হওয়াটা একটি গণতান্ত্রিক চর্চা।
তাই দলের প্রয়োজনে যেকোনো নেতা নতুন নেতৃত্বে আসতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, দলীয় কাউন্সিল হলে এমনিতেই অনেক নেতা তাঁদের পদ হারাতে পারেন। কারণ বিএনপি আগামী দিনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যাঁকে যোগ্য মনে করবে, তাঁকেই দায়িত্বে রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।