শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: ১৯৭৫ সালের ঘটনা।মিউজিক কম্পোজার আর কে শেখর মালায়ালাম মুভি পেন পাদার (১৯৭৫)মিউজিক কম্পোজিশনের কাজ করছিলেন । মুভির ৪টি গানের মধ্যে ৩টির কাজ শেষ হওয়ার পর একটু বিরতি নিলেন তিনি । সে সময় সেখানে হাজির হলো তার ৯ বছর বয়সী ছোট্ট শিশুটি। এসেই হারমোনিয়ামে মিউজিক বাজানো আরম্ভ করলো । উপস্থিত সবাই হারমোনিয়ামে বেজে ওঠা টিউনের মেলোডিতে বিস্মিত হয়ে গেলেন । তারা শিশুটিকে একটি সম্পূর্ণ গানের টিউন বানিয়ে ফেলতে বললেন ।
শিশুটি টিউন বানালো এবং সবাই সে টিউনটি এতোটাই পছন্দ করলেন যে,সেটিই মুভিতে যোগ করে দিলেন ।গানটির টাইটেল রাখলেন ভেল্লিতেন কিন্নাম পোল । কেরালার কৈরালি-স্বরালয় অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি মিউজিশিয়ান কে জে যেসুদাস এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন । আর সে ছোট্ট ছেলেটিই হলো ৮১তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস-এ মিউজিক ডিপার্টমেন্টে ডাবল অস্কার উইনার এ আর রহমান ।
স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ৮১তম অস্কার প্রতিযোগীতায় শেষ্ঠ সন্ঙ্গীত পরিচালনা এবং সর্বোচ্চ স্কোরের জন্য এ আর রহমান দুটি পুরস্কার লাভ করেন ।
১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের মাদ্রাজে বর্তমান এ আর রহমান জন্মেছিলেন এ এস দিলীপ কুমার নামে । বাবা তামিল সঙ্গীত পরিচালক আর কে শেখর এবং মা গৃহবধূ কস্তুরী দেবী । রহমানের বাবা মোটামুটি নামী সঙ্গীত পরিচালকই ছিলেন । বাবার কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা নেয়ার খুব বেশি সুযোগ পাননি । কারণ, ১৯৭৬ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান । তার পর থেকে মাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠেছেন রহমান । বাবার দুটো কি-বোর্ড ভাড়া দিয়ে তখন সংসার চলত তাদের । ১১ বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন অর্কেস্ট্রা গ্রুপের সাথে কি-বোর্ড বাজাতে শুরু করেন রহমান । সঙ্গীতকে ভালোবেসে নয়, পেট চালানোর জন্য । আর এভাবেই আস্তে আস্তে তার শয়নে-স্বপনে জাগরণে বাসা বাঁধতে শুরু করে সপ্তসুর ।
এ সংগীত শিল্পীর আগের নাম ছিল এ এস দিলিপ কুমার ।ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম হয়েছে আল্লা রাখা খান । তবে তিনি এ আর রেহমান নামেই বেশি পরিচিত । ছোট বেলায় ধর্মে খুব একটা বিশ্বাস করতেন না এ আর রেহমান ।ব্যক্তিগত জিবনে এই শিল্পী খাদিজা, রহিমা এবং আমেন নামের তিন সন্তানের জনক । স্ত্রীর নাম সায়রা বানু।
১৯৮৮ সালে অর্থাৎ দিলীপের বয়স যখন একুশ তখন তার এক বোনের গুরুতর অসুখ হয় । কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছিল না। সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন পরিবারের এক বন্ধুর উপদেশে তারা যান শেখ আবদুল কাদের জিলানি নামে মুসলিম পীরের কাছে। তিনি পীর কাদরি নামে পরিচিত ছিলেন।
পিতার রোগের সময় ওই একই পীরের কাছে দিলীপ পরিবার গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন পিতার অন্তিম সময় বলে পীর কিছু করতে পারেননি। এবার বোনের অসুখের সময় তারা দেরি করেন না। দিলীপ পরিবার যান পীর কাদরির কাছে। তার দোয়ায় অতি আশ্চর্যজনকভাবে দিলীপের বোন দ্রুত সেরে ওঠেন। পিতা ও বোনের অসুখের সময় সমাজের অবহেলা এবং তার বিপরীতে পীরের সদুপদেশ ও সাহায্য গভীরভাবে প্রভাবিত করে তরুণ দিলীপকে ধর্মান্তরিত হতে। তিনি ও তার পুরো পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দিলীপ হয়ে যান এ আর রহমান।
এখন এ আর রহমান বলেন, ইসলাম আমাকে শান্তি দিয়েছে। দিলীপ রূপে আমি একটা হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। এ আর রহমান হয়ে আমার মনে হয় পুনর্জন্ম লাভ করেছি।
দিলীপের মা জ্যোতিষবিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে যান এক জ্যোতিষীর কাছে এবং অনুরোধ করেন একটি শুভ মুসলমান নাম দিতে।
দিলীপকে দেখে ওই জ্যোতিষী তাৎক্ষণিকভাবে তার নাম আবদুল রহমান এবং সংক্ষেপে এ আর রহমান রাখতে উপদেশ দেন। দিলীপের মা এতে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, আবদুল রহমানের সংক্ষেপিত নাম তো এ রহমান হওয়া উচিত। এ আর রহমান হবে কী করে?
জ্যোতিষী উত্তর দেন, তার নাম আবদুল হলেও রহমানের আগে দু’টি আদ্যক্ষর রাখলে সে বিশ্বখ্যাত হবে। তাই শুধু (এ) নয়, এ আর -ই রাখতে হবে।
কস্তুরী ওরফে করিমা বেগম ঠিক তা-ই করেন। দিলীপের নাম রাখেন এ আর রহমান। পরে ইন্ডিয়ার তদানীন্তন টপ সুরকার নওশাদ আলী যিনি পশ্চিমি সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন তার সংস্পর্শে যখন এ আর রহমান আসেন তখন তিনি উপদেশ দেন আবদুলটা বদলে ফেলে বিখ্যাত তবলা বাদক আল্লা রাখার (Allah Rakha) নামে এ আর রাখতে।
এভাবেই এ এস দিলীপ কুমার থেকে ওরফে আবদুল রহমান ওরফে আল্লা রাখা রহমান ওরফে এ আর রহমানের পর্যায়ক্রমিক নামান্তর ঘটে।
এসব সাফল্যের জন্য এ আর রহমান সব কৃতিত্ব দেন সৃষ্টিকর্তাকে। তিনি বলেন, আমার মা আল্লাহর কাছে যেসব প্রার্থনা করেছেন তারই ফসল আমি। আমি যা তার কারণ হলো, প্রতিদিন সচেতন ও আন্তরিকভাবে পাঁচবার নামাজ পড়ি। আল্লাহ যা চান আমি তাই হবো। আমি তা জানি। তিনি আমাকে সবই দিয়েছেন। তিনি আবার সব কিছু নিয়েও নিতে পারেন। তাই যদি তিনি করেন তাহলে কোনো প্রশ্ন করব না, কোনো আপত্তি করব না। তাঁর সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেবো। আল্লাহই আমার সব কিছু। তাঁর বিশাল সৃষ্টিযজ্ঞের একটি অতি ছোট অংশ আমি। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন একটি বিশেষ মিশনের জন্য। সেই মিশনটি অর্জন না করলে আমি পাপ করব। এটাই আমার একমাত্র বিশ্বাস। আমার কাছে এটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের কোনো প্রলোভনই আমাকে নোয়াতে পারবে না। আমার জন্ম হয়েছে মিউজিকের জন্য। আমি মিউজিকের জন্যই বেঁচে আছি এবং শেষ পর্যন্ত মিউজিকের জন্যই বেঁচে থাকব। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। আমি শুধু এটুকুই জানি।
১৯৯৭ সালে তিনি উপহার দিয়েছেন বন্দে মাতরম-এর মতো মাইলস্টোন অ্যালবাম, যেটি শুধু ইন্ডিয়াতে তখন বিক্রি হয়েছিল ১.২ কোটি পিস । ১৯৯৯তে জার্মানির মিউনিখে কনসার্টে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন তিনি ।
রোজা অ্যালবামটি ২০০৫ সালের টাইম ম্যাগাজিনের ১০ বেস্ট সাউন্ডট্রাকস অফ অল টাইম লিস্টে স্থান করে নেয় । এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে । ঈর্ষান্বিত অন্যান্য কম্পোজারদের সমালোচনা তার সাফল্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারেনি ।
তার মিউজিক করা উল্লেখ করার মতো হিন্দি মুভিগুলো হলো বোম্বে (১৯৯৫), রঙিলা (১৯৯৫), দিল সে.. (১৯৯৮), তাল (১৯৯৯), লগান (২০০১), সাথিয়া (২০০২), রাঙ্গ দে বাসন্তী (২০০৬), গুরু (২০০৭), যোধা আকবর (২০০৮), জানে তু… ইয়া জানে না (২০০৮), স্লামডগ মিলিয়নেয়ার (২০০৮), ইয়ুভরাজ (২০০৮), গজনি (২০০৮), দিল্লি-৬ (২০০৯) ইত্যাদি।
এ আর রহমানের ইউনিক একটি স্টাইল হলো, তিনি সাধারণত রাতের বেলা কাজ করেন (একমাত্র লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে তিনি দিনে কাজ করেছেন)। তিনি যখন মৌলিক টিউন করেন, তখন তিনি তার বিশেষ রুমে গিয়ে বসেন এবং একা থাকেন; সঙ্গে থাকে কেবল অন্ধকারে জ্বলতে থাকা কয়েকটি মোমবাতি।